ভিক্টর বাসের চাপায় বাবার পর প্রাণ গেল কলেজছাত্রের বন্ধুর - দৈনিকশিক্ষা

ভিক্টর বাসের চাপায় বাবার পর প্রাণ গেল কলেজছাত্রের বন্ধুর

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বাবার মৃত্যুর শোকের লগ্ন কাটেনি তখনও। কুলখানির আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত গোটা পরিবার। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের কুল-খানিতে আসার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন ছেলে। শনিবার রাতে বন্ধু মেহেদী হাসান ছোটনকে (২০) নিয়ে কুলখানির খাবার ও জিনিসপত্র কিনতে টঙ্গীর উদ্দেশে রওনা হন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কণ্ঠশিল্পী পারভেজ রবের ছেলে ইয়াসির আলভী রব। গত বৃহস্পতিবার উত্তরার ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের সামনে ভিক্টর পরিবহনের বাস চাপা দিয়ে প্রাণ কেড়ে নেয় পারভেজের। প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক আপেল মাহমুদের চাচাতো ভাই তিনি। 

দু'দিনের মাথায় বাবার কুলখানির খাবার কিনতে গিয়ে আবারও একই পরিবহনের অন্য একটি বাসের ধাক্কা ও চাপায় গুরুতর আহত হন ছেলে ইয়াসির। একই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ইয়াসিরের বন্ধু ছোটন। কী ভয়ঙ্কর! বেপরোয়া বাস ইয়াসিরকে পঙ্গু করল। কেড়ে নিল বাবা ও বন্ধুর প্রাণ। আর এতে ভেস্তে গেল বাবার কুলখানির আয়োজনও। আহত ইয়াসিরকে শ্যামলীর ট্রমা সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে। আর রোববারই তুরাগের ধউর এলাকায় স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ছোটনকে।

এমন মৃত্যু আর দুর্ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না ইয়াসির ও ছোটনের পরিবার। তারা বলছেন, ভিক্টর পরিবহনের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া না হলে যে কেউ দুর্ভাগ্যের শিকার হতে পারেন। ঘাতক বাসচালক ও মালিকের শাস্তি চান তারা।

একের পর এক বেপরোয়া বাস রাস্তায় কেড়ে নিচ্ছে একেক জনের প্রাণ। আবার কারও হাত, কারও পা কাটা পড়ছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বনানীতে ফুটপাতে বাস উঠে গেলে প্রাণ হারান ফারহা নাজ নামে এক কর্মজীবী নারী। গত ২৭ আগস্ট বাংলামটরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণা রায় চৌধুরী নামে বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপকের পায়ের ওপর তুলে দেয়া হয় বাস। এতে কাটা পড়ে তার এক পা।

রোববার ট্রমা সেন্টারে কথা হয় নিহত কণ্ঠশিল্পী পারভেজ রবের স্ত্রী রুমা সুলতানার সঙ্গে। দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ইয়াসির বেডে শুয়ে; শরীরে স্যালাইন চলছে। তার পাশেই চেয়ারে মলিন মুখে বসে আছেন তার মা রুমা সুলতানা। মাঝেমধ্যে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর গুমরে কেঁদে উঠছেন। রুমা জানান, শনিবার বিকেলে ধউর এলাকার স্থানীয় আবুল মাতুব্বরের বাড়িতে সমঝোতা বৈঠক হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিল তার বোন কামরুন্নাহার ও বোন জামাই বাবুল। অন্য পক্ষে ছিল ভিক্টর পরিবহনের মালিকের লোকজন। বৈঠকে তার বোন দুর্ঘটনার জন্য বাস কর্তৃপক্ষের কাছে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। এক পর্যায়ে তা ২০ লাখ টাকায় নেমে আসে। তবে বাসের মালিক পক্ষ জানায়, তারা এত টাকা দিতে পারবে না। পরে বাস মালিকের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবেন। ওই সমঝোতা বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর শনিবার রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন তিনি। এতে বাসচালক, হেলপারসহ কয়েকজনকে আসামি করা হয়। মামলা করার সময় খবর পান ছেলে তার বন্ধুকে নিয়ে বাবার কুলখানির খাবার কিনতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।

রুমা আরও জানান, বাসের মালিক পক্ষ বার বার হুমকি দিচ্ছিল, দেখি সাংবাদিকদের দিয়ে আপনারা কত লেখাতে পারেন। অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন, 'স্বামীকে হারালাম। সন্তানদের নিয়ে এখন কোথায় দাঁড়াব?' ধউর এলাকায় বড় হয়েছে তার ছেলে। হয়তো ভিক্টর পরিবহনের চালক ও হেলপার তার ছেলেকে আগে থেকে চিনত। তাই বাসের ওঠার চেষ্টা করলেও দরজা বন্ধ করে এঁকেবেঁকে বাস চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। তবে বাসে ওঠার সময় তার ছেলে জানত না ওই বাসটি ভিক্টর পরিবহনের।

রুমা জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর তার ছেলে বা ছেলের বন্ধুরা রাস্তায় কোনো গাড়ি ভাঙচুর করেনি। গাড়ি চলাচলে বাধা দেয়নি। অনেকে বলছিল, গাড়ি আটকাতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় ছেলে ও তার বন্ধু দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে- এটা ঠিক নয়। গাড়ি আটকাতে কেন দু'জন রাতে সেখানে যাবে।

অসহায়ত্ব প্রকাশ করে রুমা সুলতানা বলেন, চার দিন আগে তার স্বামী পারভেজ রবকে বাসচাপা দিয়ে 'হত্যা' করা হয়েছে। একই কোম্পানির বাসে আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে ছোট ছেলে ইয়াসির। কোমরের হাড় ভেঙে গেছে। সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন স্বামী পারভেজ। তিনি নেই। ছেলের চিকিৎসা খরচ কীভাবে জোগাবেন তা নিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তিনি জানান, রোববার দুপুর পর্যন্ত ছেলের চিকিৎসা বাবদ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন চিকিৎসা খরচ বহন করার মতো সামর্থ্য তার নেই। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'স্বামীর শোক না কাটতেই ছেলে হাসপাতালে! কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কীভাবে বাঁচব? কে দেখবে আমাদের? ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচইবা কোথায় পাব?' দুর্ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

রুমা সুলতানা জানান, রোববার তার স্বামীর মৃত্যুর চতুর্থ দিন ছিল। এদিন কুলখানি করার কথা ছিল তাদের। কিন্তু ছেলে হাসপাতালে থাকায় কুলখানির অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে চিকিৎসাধীন ইয়াসির বলেন, তিনি শনিবার সন্ধ্যায় বাবার কুলখানি অনুষ্ঠানের কেনাকাটা করতে যাচ্ছিলেন টঙ্গী বাজারে। সঙ্গে ছিল বাল্যবন্ধু মেহেদী হাসান। ধউর এলাকার বাসা থেকে বেরিয়ে বাস না পেয়ে আব্দুল্লাহপুরগামী একটি ছোট্ট ট্রাকে ওঠেন তারা। বেড়িবাঁধ স্লুইসগেটে পৌঁছালে যানজটে ট্রাক থেমে যায়। এ সময় তারা নেমে পড়েন। যানজটে আটকে থাকা ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের বাসে ওঠার চেষ্টা করেন। বাসে ওঠার আগেই হেলপার ভেতর থেকে দরজা আটকে দেন। পরে তিনি দরজার পাশের খোলা জানালা দিয়ে গেট খুলতে অনুরোধ করেন হেলপারকে। সে সময় চালক ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বাস বেপরোয়াভাবে টান দেন। জানালা ধরে তিনি বুক থেকে মাথার অংশ বাসের ভেতরে ঢুকিয়ে চিৎকার করতে থাকেন- 'তিনি বাসে ঝুলছেন'। বাস থামাতে চালককে অনুরোধ করেন। কিন্তু তার কথা কর্ণপাত করেননি চালক। এঁকেবেঁকে বাস টানতে থাকেন। 

ইয়াসির বলেন, 'বাসের সামনের দিকে একটি মিনিবাস ছিল। ওই বাসের সঙ্গে আমার ও মেহেদীর চাপা লাগে। মনে হলো আমার কোমর থেকে হাড় ভেঙে গেল। ১৫-২০ গজ এ অবস্থায় সামনের দিকে যাওয়ার পর চলন্ত অবস্থায় আমি হাত ছেড়ে দিলে রাস্তায় পড়ে যাই। আর উঠে দাঁড়াতে পারিনি।'

মোবাইল ফোনে ইয়াসির দুর্ঘটনার খবর জানান এক বন্ধুকে। কাছাকাছি থাকায় ওই বন্ধু ছুটে এসে আহত অবস্থায় মেহেদী ও ইয়াসিরকে রিকশায় করে প্রথমে উত্তরা এলাকার আল আশরাফ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মেহেদীকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। রাতেই ইয়াসিরকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রোববার দুপুরে সেখান থেকে ট্রমা সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে। তার কোমরের ডান পাশের হাড় 'ফ্যাকচার' হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা।

পারভেজ রবের বন্ধু খালেদ মাহমুদ বলেন, রোববার স্বামীবাগের বাসায় পারভেজ রবের কুলখানি হওয়ার কথা ছিল। কীভাবে আয়োজন করা যায় তা নিয়ে শনিবার ধউর এলাকার তার বাসায় আত্মীয়স্বজনরা মিলিত হন। সেখান থেকে শনিবার রাতে মামলা করতে একটি গ্রুপ যায় থানায়। আরেকটি গ্রুপের দায়িত্ব ছিল কেনাকাটার। থানায় থাকার সময় দুর্ঘটনার খবর জানার পরপরই মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বজনরা।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ইয়াসিরের এক ভাই ও এক বোন। তার বড় ভাই ইয়াসিন ইসরাফ রব মালয়েশিয়ায় পড়ালেখা করেন। ছোট বোন রামিসা ইবনাথ কামারপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। ইয়াসির উত্তরা টাউন কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা থানার সোনারচরে।

এদিকে রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে মেহেদীর লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে লাশ নেয়া হয় ধউর এলাকার বাসায়। বিকেলে ধউরের এলাকার কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। তিনি এইচএসসি পাস করার পর আর পড়ালেখা করেননি। চাকরি খুঁজছিলেন। মেহেদীর বাবা ইউসুফ মিয়া জানান, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মেহেদী ছোট। চাকরি পাওয়ার পর অনার্স ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না। মেহেদীর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে।

নিহত মেহেদীর মামাতো ভাই ও মামলার বাদী ফিরোজ আলম বলেন, 'কেউ কোথাও যেন নিরাপদ নয়। বিচার চাওয়া ছাড়া আর কী বলব। চালকরা যেন নেশার ঘোরে গাড়ি চালায়। কাউকে পরোয়া করে না ওরা।'

একই পরিবহনের দুই বাসের চাপায় প্রাণ যাওয়ার ঘটনায় করা দুটি পৃথক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হলেন উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই মো. সাদেক। তিনি জানান, পথচারীদের সহায়তায় শনিবারের দুর্ঘটনার পরপরই ভিক্টর পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৮৬৭০) চালক রফিকুল ইসলামকে আটক করা হয়েছে। চালকের সহকারী সোহেল ও কন্ডাক্টর মোমেন পালিয়েছে। দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩০৪(খ) ও ৩৩৮ (ক) ধারায় মামলা হয়েছে। মামলায় সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে দু'দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। তবে পারভেজ রবের দুর্ঘটনায় দায়ী বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-০৩৫৫) চালক মো. শাহ আলমকে গ্রেফতার করা যায়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, শনিবার দুর্ঘটনায় দায়ী চালকের কাছে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেছে। তা প্রকৃত কি-না জানতে বিআরটিএ’তে পাঠানো হবে। ওই বাসের মালিক জনৈক দুলাল বলে জানিয়েছেন চালক। তারও আসল পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0065698623657227