ভিসি-প্রিন্সিপাল পদগুলোও সাংবিধানিক করা হোক - দৈনিকশিক্ষা

ভিসি-প্রিন্সিপাল পদগুলোও সাংবিধানিক করা হোক

মাছুম বিল্লাহ |

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনও একটি ঘটনা ঘটলেই কর্তৃপক্ষের সহজ সমাধান হলো, হল খালি করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা। এই পুরনো টোটকা কতদিন চলবে? বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পর মাত্র দুই সপ্তাহ ক্লাস হয়েছে এই কুয়েটে। তারপর সেখানে দুই ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তাতেও এক সপ্তাহ ক্লাস বন্ধ থাকে। সে রেশ কাটতে না কাটতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ বছর বয়স্ক তরুণ ও মেধাবী শিক্ষক ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের করুণ, মর্মান্তিক ও রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত ৩ ডিসেম্বর বিকেল চারটার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ মেয়ে শিক্ষার্থী। হঠাৎ করে হল বন্ধ হলে এবং বিকেল চারটার মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ দিলে মেয়েরা কোথায় যাবে এ বিষয়টি আজও পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় এলো না। এই হঠাৎ করে বন্ধ হওয়ার কালচার শুরু হয়েছে সেই এরশাদ আমল থেকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোটা সময়ই কেটেছে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও এরশাদ ভ্যাকেশনে। একবার এমন হয়েছিল কর্তৃপক্ষ বিকেল পাঁচটার মধ্যে যখন হল ছাড়তে বলল তখন কোথায় যাব? এদিক পুলিশের গাড়ি মহা উৎসাহে চারদিক ঘিরে ফেলেছে, লাঠিসোটা আর বন্দী করার সব সরঞ্জাম নিয়ে হাজির। কোনওদিকে যাওয়ার পথ নেই।বহু কষ্টে বেরিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট অফিসের পিওনের ছোট কক্ষে সারারাত কাটালাম, সারারাত দেখলাম পুলিশের গাড়ির টহল, মনে হচ্ছে যেনযুদ্ধাবস্থা! পরদিন সকালে অতি সন্তর্পণে রাস্তায় এসে কোনও রকমে একটি গাড়িতে চেপে বসলাম বরিশাল যাওয়ার জন্য। কারণ পথে পথে পুলিশের তল্লাশি, ছাত্র পেলেই আর কথা নেই। পুলিশের সে কী উৎসাহ আর বীরত্ব!

এর আগে কয়েকবার এরকম হওয়ায় ঢাকায় চলে আসতাম। ভাবছিলাম নারী শিক্ষার্থী যাদের বাড়ি অনেক দূরে এবং ঢাকায় যাদের সে রকম আত্মীয়-স্বজন নেই তাদের এই পরিস্থিতিতে কী অবস্থা হয়? তবে জাহাঙ্গীরনগরে যারা পড়েন, তাদের হয়তো কোনওভাবে ঢাকায় থাকার একটা ব্যবস্থা হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর থেকে ওই সময়ে ঢাকা যাওয়াটাও খুব নিরাপদ নয়। কিন্তু খুলনা, পটুয়াখালী, দিনাজপুর কিংবা সিলেট এসব যায়গার উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হঠাৎ বন্ধ হওয়া আর হঠাৎ হল ছেড়ে দেয়ার ঘটনা নারী শিক্ষার্থীদের মহা বিপদে ফেলে দেয়। কাজেই কর্তৃপক্ষের বিষয়টি সুবিবেচনায় নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত জীবনের ছোঁয়ায় আর রাজনীতির ছত্রচ্ছয়ায় কী সব কাণ্ড ঘটাতে পারে এবং ঘটাচ্ছে, তা যারা রাষ্ট্রপরিচালনা করেন তাদের সবই জানা। এসব শিক্ষার্থী ধরাকে সরা জ্ঞান করে, তোয়াক্কা করেনা কাউকে। ক’দিন আগে আমরা দেখলাম সিলেট মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে নিজ সংগঠনের হয়েও কীভাবে সহপাঠীদের কাছে মূল্য দিতে হয়েছে (মাথার খুলি সরিয়ে ফেলেছে)! তারপরেও আমরা এগুলোকে প্রশয় দিই। জনাব সেলিম হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন, কারণ শক্তিশালী সংগঠনেরকিছু ছাত্র তার সাথে চরম খারাপ আচরণ করেছে, যা তিনি শিক্ষকহিসেবে সহ্য করতে পারেননি।জানা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলে ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচন নিয়ে কয়েকদিন ধরে ছাত্রনেতারা প্রভোস্ট ড. সেলিম হাসোনকে চাপ সৃষ্টি করছিলেন। ২৯ নভেম্বর দুপুরে নেতারা ওই শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং হুমকি দেন। তার পরপরই তার মৃত্যু হয়। 

ছাত্ররা এটি করেছে কারণ তারা জানে তারা এটি অনায়াসে করতে পারে, কেউ তাদের কিছু বলতে পারবেনা। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক কিংবা কর্তৃপক্ষের কিছু করার সাহস নেই।তারা কিছু করলেও তাদের কিছু হবেনা। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এগুলো কি চলতেইথাকবে? কুয়েটে চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ শিক্ষার্থী নারী, ভাবতেই কত ভাললাগে। আমার দেশে তৈরি হচ্ছে এতগুলো উচ্চশিক্ষিত নারী, এত তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী। তারা দেশকে পাল্টে দিতে পারে। কিন্তু যখন এসব ঘটনা দেখি, তখন আশা জাগানোর জায়গাগুলো মেঘের অন্ধকারে ঢেকে যায়। সামান্য স্বার্থে এরা কীভাবে নিজেদের জীবন ও পুরো শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে। এতসব মেধাবী শিক্ষার্থী যদি সুন্দর ক্যাম্পাসে বসে নিজ শিক্ষকের সাথে এ ধরনের আচরণ করতে পারে তাহলে তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে জাতিকেকীদেবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জনগণ যে ট্যাক্স প্রদান করছে,তার বিনিময়ে তারা এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সে সত্যকে অনুধাবন করার শিক্ষা যদি তারা এখান থেকে না পায়, তাহলে বলতে হয় জাতি অমানিশার অন্ধকারে ঢেকে যাবে।

আমরা অনেক অবাক করা বিষয়ের মধ্যে আর একটি অবাক করা বিষয় লক্ষ করি। টেলিভিশন তো দেখা হয়না, যদি হঠাৎ কখনও সুইচ টিপ দেই, দেখি সংসদে কত ধরনের কথা হয়। কিন্তু শিক্ষার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কত যে দৈন্যদশা এ নিয়ে খুব একটা  আলোচনা থাকেনা। পত্রিকায় দেখলাম শিক্ষক সেলিমের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের জন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কমিটির দুজন তদন্তকাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এখানেই তো অনেক রহস্য। হতে পারে উক্ত দুই শিক্ষক যে কালারের, মৃত্যুবরণকারী শিক্ষক সে কালারের নন। অথবা, তারা জানেন, তারা যে রিপোর্ট দেবেন সেটি তারা যেভাবে চাইবেন সেভাবে দিতে পারবেন না। অথবা হতে পারে কোন অজানা ইঙ্গিত তাদের তদন্তকাজ চালাতে না করা হয়েছে।এভাবেই আমরা সত্যকে চাপা দিতে থাকি। চাপা দিতে দিতে পরিস্থিতি এমন হয়েছে। এরই মধ্যে দেখলাম ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ছাত্র সংগঠনের দুই পক্ষের সংঘর্ষে। 

সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও আবেগে কিছুদিন ক্লাস বর্জন করবেন, মানববন্ধন করবেন তারপর প্রকৃতির নিয়মেই ধীরে ধীরে মানুষ ভুলে যাবে। গুরুত্ব পাবে দেশের অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন একটা ঘটনা, যা এ ঘটনাকে তুচ্ছ করে ফেলবে কিংবা সবার দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ করবে। এসব ঘটনার যারা হোতা কিংবা নিয়ন্ত্রক, তারা জানে কীভাবে পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে হয়।  তরুণ শিক্ষার্থীরাকোন অজানা ইঙ্গিতে বা নির্দেশে শুধু রক্ত গরম করা বক্তব্য দেবে, প্রতিপক্ষকে হামলা করবে, হলের দখল নেবে। কিন্তু এগুলো সমাজকে কিছুই দেয়না, বরং গোটা সমাজে বিস্তার লাভ করে অশান্তির কালো ছায়া। ছাত্রজীবনে যেসব বন্ধুকে দেখেছি হকিস্টিক নিয়ে মারামারি করতে আর পিস্তল হাতে নিয়ে সহপাঠীদের তাড়া করতে, তাদেরই দেখছি চাকরির জন্য একই কাতারে এসে প্রতিযোগিতায় নামতে। কেউ হয়তো অন্য পথে হেঁটে সামান্য কিছু পেয়েছে, কিন্তু সবাই তো না।

আর একটি দুঃখজনক ও উদ্বেগের বিষয় হলো, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তো এখন প্রকৃতঅর্থে কোন অভিভাবক নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ প্রতিষ্ঠান সৎভাবে, সঠিকভাবে চালাতে আসেন না, তারা আসেন অন্যকোনও এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। তাই তাদের কাছ থেকে কোন নিরপেক্ষ, সৎ ও সাহসী কোনও পদক্ষেপ বা ভূমিকা কেউ আশা করতে পারেন না। তাই এসব দু:খজনক ঘটনার পরে তাদের বক্তব্য বা ভুমিকা সেটি নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামান না।কারণ সবাই জানে উনারা কিছুই করতে পারেন না। তবে, নিরীহ ছাত্রদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে আবার পিছপা হন না। আমাদের যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী তো ক’দিন আগে বলেছেনই যে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা ছাত্রদের কথায় ওঠেন আর বসেন।’ আমরাতো তা অহরহ দেখছি ।

এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে অবস্থা, তাতে বর্তমান পদ্ধতির ভিসি বা কলেজগুলোর অধ্যক্ষ পদের পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাদের দ্বারা বর্তমান পরিস্থিতির শিক্ষাব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা সম্ভব নয় এবং হচ্ছেওনা। এই পদগুলোকে সাংবিধানিক পদের মতো চিন্তা করা প্রয়োজন যাতে তারা নিজেদের মতো কাজ করতে পারেন, এবং ইচ্ছে করলেই কেউ তাদের অপসারণ করতে পারবেন না। প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনও শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন যদি গরম গরম দু একটা মিছিল দেয়, চোখ রাঙিয়ে কথা বলে, তাহলেই দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠান প্রধানদের গদি টলমলে হয়ে যায়। তাই তারা স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দেন। কিন্তু এর ভবিষ্যত কী? প্রকৃত উচ্চশিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীরা কি শিক্ষিত হবেন না, আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কি প্রকৃত উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ দেশে কখনই পাবেন না?এভাবেই পেশীশক্তির প্রদর্শনী চলতে থাকবে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে?

 লেখক : প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ইট্যাব)। 

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0077629089355469