অর্থ মন্ত্রণালয় না চাইলেও আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাটের (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ থাকার প্রস্তাব থাকছে। তবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদানকারীদের রেয়াত নেওয়ার সুবিধা রাখা হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে।শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ফারজানা লাবনী।
পাশাপাশি আগামী বাজেটে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নতুন কর আরোপের পরিবর্তে করজাল বিস্তারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে। সারচার্জের পুনর্বিন্যাস করা হবে। সুপার ট্যাক্স গ্রুপের কাছ থেকে হিসাবমতো রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা বাড়ানো হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়াতে শিল্পের বিভিন্ন খাতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে।
এনবিআর সূত্রে আরো জানা গেছে, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো এবং সব খাতে করপোরেট করহার কমানোর জোরালো দাবি থাকলেও তাতে রাজি নয় এনবিআর। সুনির্দিষ্ট একটি বা দুটি খাতে করপোরেট করহার কমানো হলে রাজস্ব আদায় কতটা কমে যাবে তার হিসাব কষছে প্রতিষ্ঠানটি। শুল্ক খাতে মিথ্যা ঘোষণা বন্ধে প্রযুক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, অতীতের ধারা থেকে সরে এসে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব বাজেট সহজ ভাষায় এবং অল্প কথায় লিখতে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। চলতিবারের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরেও ভ্যাট থাকছে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত। ভ্যাটের পরেই থাকবে আয়কর। সব শেষে শুল্ক। এনবিআর আগামী অর্থবছরে ভ্যাট আইন ২০১২ বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আগামী অর্থবছরে ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১০ শতাংশ নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হলেও তা মানতে রাজি নয় এনবিআর। সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণের কাজ শুরু করেছে। এর পরের স্তর হচ্ছে ১০, ৭.৫ ও ৫ শতাংশ। তবে বহুস্তরবিশিষ্ট ভ্যাটের শূন্য হার না রাখার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে এনবিআর। আগামী অর্থবছরেও নিত্যপণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি রাখা হচ্ছে। সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানকারীদের রেয়াত নেওয়ার সুবিধা থাকছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে ভ্যাট আইন ২০১২ বাস্তবায়নের প্রস্তুতি
নিচ্ছি। আইনটিতে ভ্যাটের কয়েকটি হার থাকবে। ১৫ শতাংশ হারে যারা ভ্যাট দেবে, তাদের রেয়াত দেওয়া হবে। আমদানি ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ দিতে হবে। রেয়াত পেলে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ কমবে।’ তিনি যুক্তি দেখান, ‘১৫ শতাংশ যেটা আছে সেটা যদি আমরা ১০ শতাংশ করে দিই, আর তারা যদি রেয়াত না পায়, তাহলে ১০ শতাংশ পুরোপুরি কিন্তু ভোক্তার ওপর চলে যাবে। এতে দাম বাড়বে। তাই জনস্বার্থে ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১০ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা প্রয়োজন।’
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে অনলাইনে ভ্যাট প্রদান বাধ্যতামূলক করা হবে। ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ইএফডিআই (ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) মেশিন প্রদানের কথা থাকলেও এনবিআরের প্রস্তুতি না থাকায় তা হচ্ছে না। প্রথম ধাপে ১০ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে এ মেশিন দেওয়া হতে পারে। তবে অর্থমন্ত্রী এ সংখ্যা আরো বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ মেশিনের সফটওয়্যারের সঙ্গে এনবিআরের তথ্যভাণ্ডার যুক্ত থাকবে। এনবিআরের কর্মকর্তারা নিজেদের দপ্তরে বসে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভ্যাট প্রদানের তথ্য যাচাই করতে পারবেন।
আগামী অর্থবছরে বিড়ি-সিগারেটের পাশাপাশি জর্দা ও গুলের ওপরও রাজস্ব বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার আগামী দিনেও বহাল রাখা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এনবিআরে চিঠি পাঠিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে রাজস্ব বাজেট প্রণয়নের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আগামী দিনে বাজেট ঘোষণার পর ভ্যাট আইন ২০১২সহ রাজস্ববিষয়ক কোনো বিষয়ে বিতর্ক হলে এর দায় এনবিআরকে নিতে হবে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতেও এনবিআরকে ‘না’ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আয়কর আদায়ে নতুন কর আরোপের পরিবর্তে অর্থমন্ত্রী রাজস্বজাল বিস্তারে জোর দিয়েছেন। বিশেষভাবে তৃণমূলের সম্পদশালীদের খুঁজে বের করতে সব উপজেলায় রাজস্ব দপ্তর স্থাপনে এনবিআরকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। অর্থপাচার কমাতে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধে প্রতিটি বন্দরে স্ক্যানিং মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আগামী বাজেটে নির্দেশ থাকবে। মূলধনী যন্ত্রপাতি, কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে।
গত মার্চ থেকে রাজস্ব বাজেট প্রস্তুতির কাজ শুরু করে এনবিআর। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তিন লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে রাজস্ব বাজেট প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেও এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে তিন লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণে জোরালো দাবি করে। বিষয়টি আমলে এনে অর্থমন্ত্রী ১৬ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে আপাতত রাজস্ব বাজেট প্রস্তুতির কাজ শুরু করতে বলেছেন। এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে অর্থমন্ত্রী এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করবেন। আপাতত তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাজস্ব বাজেট প্রস্তুতির কাজ শুরু করা হয়েছে।’