যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন মন্ত্রিসভার শীর্ষস্থানীয় ছয় সদস্যের নাম ঘোষণা করেছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নেয়ার আগে সোমবার রাতে তিনি তাদের নাম ঘোষণা করেন।
এদিকে জো বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে সম্মত হয়েছেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর জন্য সোমবার তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দিয়েছেন। খবর বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা ও সিএনএনের।
নতুন প্রশাসনের জন্য বেছে নেয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায় সবাই ২০০৯-১৭ সাল পর্যন্ত ওবামা-বাইডেন প্রশাসনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে নতুন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। বারাক ওবামা প্রশাসনের শেষ সময়ে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ব্লিংকেন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাইডেন। ২০১৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। নতুন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদেও কেরি সদস্য থাকবেন বলে জানিয়েছে বাইডেনের কার্যালয়।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পেয়েছেন লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে জ্যাক সুলিভানকে দায়িত্ব দিয়েছেন বাইডেন। বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সুলিভান তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন।
জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক হিসেবে নারী কর্মকর্তা অ্যাভ্রিল হাইনেসকে মনোনয়ন দিয়েছেন বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে একজন নারী ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে কোনো ল্যাটিন-আমেরিকান বংশোদ্ভূতকে বেছে নেয়া হল। এর আগে তিনি ডেপুটি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ট্রেজারি সেক্রেটারি বা অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন জ্যানেট ইয়েলেন। তিনি এর আগে দেশটির ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন।
কিউবান বংশোদ্ভূত আলেহান্দ্রো মায়েরকাসকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। নাগরিকত্ব ও অভিবাসন সেবা বিভাগের সাবেক পরিচালক মায়োরকাস আগে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সহকারী মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
ছয় সদস্যের নাম ঘোষণা করে বাইডেন বলেন, ‘আমি এমন একটি টিম নিয়ে কাজ করতে চাই, যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকার ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারে আমাকে সাহায্য করবেন। যাতে আমি বিশ্বের সামনে থাকা বৃহৎ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারি।’ সদস্যদের সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা একইসঙ্গে অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত এবং উদ্ভাবনী ও ধীশক্তির অধিকারী।
অবশেষে ক্ষমতা হস্তান্তরে সম্মত ট্রাম্প : পরাজয় না মানায় অনড় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিশিগান রাজ্যে নিজের লোকজন দিয়ে সার্টিফিকেশন বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোমবার বিকালে সেখানে বাইডেনের বিজয় আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সার্টিফাই’ হওয়ার পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। এরপর ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্মত হন। সোমবার রাতে তিনি বাইডেন শিবিরের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বিদায়ী ও আসন্ন প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করে জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএসএ)। ট্রাম্প বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তর দেখভালকারী কেন্দ্রীয় সংস্থার যা যা করা দরকার, তা অবশ্যই ‘করা উচিত’। তিনি বলেন, জিএসএর কাজে তিনি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চান না। নিজের টুইট পোস্টে হার মেনে নিতে অস্বীকারের কথা জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের মামলা জোরালোভাবে চলছে। আমরা কঠিন লড়াই চালিয়ে যাব। আমার বিশ্বাস, আমরা জয়ী হব।’ এমিলি মারফিকে জিএসএ প্রধান হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন ট্রাম্প। নির্বাচনের ফল সার্টিফিকেশন ও আইনি চ্যালেঞ্জসহ সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহকে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে মারফি উল্লেখ করেন। তবে হোয়াইট হাউসের দিক থেকে কোনো চাপের বিষয়টি তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘পরিষ্কার করতে চাই, আমি প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত করতে কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে আমি অনলাইনে, ফোনে এবং ই-মেইলে হুমকি পেয়েছি। এমনকি হাজার হাজার হুমকির মুখেও আমি আইনকে সর্বাগ্রে রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলাম।’ নির্বাচনের পর রুটিন কাজ হিসেবে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করতে না পারায় দুই রাজনৈতিক শিবির থেকেই মারফির তুমুল সমালোচনা হচ্ছিল।
ট্রাম্পের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর জিএসএ বলেছে, তারা বাইডেনকে ‘আপাত বিজয়ী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আগামী ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের অভিষেকের বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে তারা।
জিএসএর এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাইডেন টিম। হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নিতে ট্রানজিশন টিমকে সরকারি সহায়তা ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বাইডেনও। মসৃণ ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাইডেন টিমের এক বিবৃতিতে বলা হয় : জিএসএর সিদ্ধান্ত একটি চূড়ান্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপ। আমাদের জাতির সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলো মোকাবেলার জন্য সিদ্ধান্তটি একটি উপযুক্ত পদক্ষেপ। মহামারী নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং আমাদের অর্থনীতিকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনার মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় এর প্রয়োজন ছিল।
বাইডেনের ট্রানজিশন টিমের নির্বাহী পরিচালক ইয়োহান্নেস আব্রাহাম বলেন, মসৃণ ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং সহায়তা দিতে জিএসএ জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসকে নিশ্চিত করেছেন। এখন তারা দ্রুত কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।
প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন জ্যানেট ইয়েলেন : বাইডেনের ট্রানজিশনাল টিম জানায়, ট্রেজারি সেক্রেটারি বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন জ্যানেট ইয়েলেন। তিনি এর আগে দেশটির ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন। জ্যানেট ইয়েলেনকে অর্থমন্ত্রী করার মধ্যদিয়ে এ পদে ২৩১ বছর ধরে চলা লিঙ্গবৈষম্য দূর হতে যাচ্ছে। ১৭৮৯ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে লেবার মার্কেট বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হলেও এবারই প্রথম এ পদে নারীকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দূর করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন ইয়েলেন। করোনা পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা করের বোঝা থেকে সাধারণ নাগরিকদের বের করে এনে অর্থনীতিকে স্বাভাবিকীকরণের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হচ্ছে।