মাগো ভাবনা কেন - Dainikshiksha

মাগো ভাবনা কেন

কাজী লুৎফুন্নেসা |

শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষক অভিভাবক সকল পক্ষ মিলে একটি বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে আমরা সবাই কাজ করছি, আর তা হলো আগামী দিনে যারা জাতির নেতৃত্ব দেবে সেই ছোট্ট সোনামনিদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা। কেন যেন মনে হয় রুটিন ওয়ার্কের বাইরে গিয়ে সৃজনশীল মানসিকতা নিয়ে করা কোন কাজ খুব বেশি চোখে পড়ে না বললে অত্যুক্তিও হয়না। অবশ্য এর মাঝেও যে আশা জাগানিয়া কিছু মানুষ স্বপ্রণোদিত এগিয়ে আসছে, স্বপ্ন বুনে দিচ্ছে আগামী সূর্য সৈনিকদের। ঠিক তেমনি একটি ব্যতিক্রমী আয়োজনের গল্প নিয়ে আমার এই উপস্থাপনা। বৃহস্পতিবারের কুয়াশা ঢাকা ভোর। তাতে কি হয়েছে? আলোক রশ্মিকে সামাল দেওয়ার শক্তি কুয়াশা  কতক্ষণই বা ধারণ করবে। বৃহস্পতি যেন সেদিন সত্যিই একাদশের বৃহস্পতি হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল যশোর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল এন্ড কলেজ মিলনায়তনে। শিক্ষক, অভিভাবক ও মেধাবী সোনামনিদের অপূর্ব সম্মিলন! যেন এক মিলনমেলা। সবটুকু তার প্রকাশ করা যায় না, যতটা না উপলব্ধি করা যায়।

মিলনায়তনে ঢুকেই চোখে পড়লো ব্যানারে লাল সবুজে লেখা-“আমার বাংলাদেশ, আমার গর্ব”। ব্যাকগ্রাউন্ডে অনন্য সংযোজন বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সুশোভিত প্রকৃতি, ম্যানগ্রোব সুন্দরবন, পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, আস্থার প্রতিক সুপ্রীম কোর্ট, লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই বীর সেনাদের বীরত্ব গাঁথা-সবকিছু মিলে যেন একাকার, একখন্ড বাংলাদেশ। সুসজ্জিত মিলনায়তনের সেই দৃশ্যপট দেখে কিছুটা হলেও অনুমান করা যাচ্ছিল আয়োজনের স্বার্থকতা। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হলো এক্সক্লুসিভ ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ডাক ‘২৭ মার্চ ২০১৫’ এর একটি দৃশ্য। যেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা হত দরিদ্র, সাহায্য প্রার্থী কিন্তু জাতীয় পতাকার কোন অমর্যাদা হতে দেননি। একই সাথে তার পাশে এগিয়ে আসে এ প্রজন্মের সাহসী সন্তানেরা।

জীবনে চলতে গেলে সঠিক পথে না চললে কী বিপর্যয় আসতে পারে; বিপদে ধৈর্য্য ধরে সকল প্রতিকুলতাকে কিভাবে জয় করতে হয়; জঙ্গিবাদের নিষ্ঠুরতার পাশেই একটি কুকুর আর ডলফিনে বন্ধুত্ব ও কৃতজ্ঞতা;  দেখতে দেখতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মানবিকতা ও মূল্যবোধের বন্ধ দুয়ার গেল খুলে। যেন বললো, “এসো দেখ, তুমিও এই আলোর পথযাত্রী”।

পায়ে জুতা নেই সেই দুঃখী মানুষের জন্যে ছোট্ট ছেলেটির নিজের জমানো টিফিনের টাকা থেকে জুতা কেনা-সাথে বাবার উৎসাহ; ক্ষুধার্ত শিশু ও বৃদ্ধকে রেস্তোরায় বসে নিজের খাবার প্রাণ ভরে খেতে দেওয়া। রেস্তেরার বিলটিতে লেখা “We don’t charge for humanity” – এমন দৃশ্য দেখে ওদের হৃদয়ের দুয়ার খুলে গেছে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা আগামী সূর্যসেনারা প্রস্তুত মানবিকতার এই পথে চলতে।

বাল্যবিবাহ বন্ধ করার অপূর্ব কৌশল-সবাইকে সচেতন হতে হবে; গড়তে হবে ঐক্য; ইভটিজিং এর প্রতিবাদ, নারীর প্রতি সহিংসতা আর নয়, কখনো নয়। এটি সব ধর্ম, সব মানবিকতার এক উচ্চারণ “Every religion protects women: Protecting women is religion” সকল ধর্মের জন্যে এই উক্তিটি শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে অনুরোণিত হলো। সেই সাথে ধিক্কার জানালো সেই অমানুষ আত্মীয়দের যারা ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে বস্তায় ভরে ফেলে রেখে যায়। প্রায় ২ ঘন্টা ৩০ মি. সময় কোথা দিয়ে চলে গেল ওরা বুঝতেই পারেনি। ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছুই ছিল না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন ছিল মাঝে মাঝে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্তরের যার মাধ্যমে ওদের সৃজনশীলতা ও কল্পনার বিস্তার ঘটেছিল। এর পর ১২ মিনিটের একটি লিখিত প্রশ্ন উত্তর পর্ব শেষে ওদের অনুভুতি প্রকাশের পালা। সবাই বলেছে অফুরন্ত ভালোলাগার কথা-সব শিক্ষার্থীদের জন্যে (একেবারে উপজেলা থেকে) করতে হবে এমন আয়োজন।

উপস্থিত সকল প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের জন্য মতামত প্রকাশের সুযোগও ছিল। সকল শিক্ষকই এই প্রয়াসের ভূয়শী প্রশংসা করেন ও শিক্ষার্থীদের জন্য বারবার এমন আয়োজনের আশা রাখেন। সবচেয়ে বেদনার কথা ছিল যখন অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে অতিথিবৃন্দ শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেছিলেন, “কারা গাইড বই পড় না হাত উঠাও” একটি হাতও ওঠেনি বরং শিক্ষার্থীরা সবাই বিভিন্ন গাইড বইয়ের নাম বলতে থাকে। গাইড বই পড়া নিষেধ এই কথাটি ওরা জানেই না। এখন ওদের প্রতিজ্ঞা “গাইড বই পড়বো না”। এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবে কি না জানি না।

আচ্ছা “আমার বাংলাদেশ আমার গর্ব” এই আয়োজনের মতো কী ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা যায় না? বোর্ডের বইগুলোর মতো সকল শিক্ষার্থীদের ৫ম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সকল বইয়ের জন্য একই মানের ভিডিও ফুটেজসহ ডিজিটাল কনটেন্ট এর মাধ্যমে পাঠদানের উদ্যোগ কি নেওয়া যায় না? নিশ্চিত করে বলা যায় গাইডের প্রয়োজন ফুরাবে। সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের স্কুল কলেজে যাবার তাগিদ নিজেদেরই থাকবে। ৫ম শ্রেণী থেকেই বোর্ড প্রশ্নে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় প্রশ্ন ব্যাংক এরই মধ্যে চালু হয়েছে যা সম্পূর্ণ বোর্ড অনুমোদিত বইনির্ভর। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার ক্ষুদ্র মস্তিস্কের এই পরিকল্পনাটি ব্যক্ত করার জন্য।
সবাই মিলে ভাবতে হবে আমাদের সন্তানদের জন্য উন্নত বিশ্বের সেই শিক্ষা- যেখানে বই, লেখাপড়া সব স্কুলে; বইয়ের বোঝা পিঠে নয়-নয় প্রতিবছর একটি করে নতুন বিষয় সংযোজন (আরও একটি প্রাইভেট পড়া), পড়ার মধ্যে থাকবে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।

“আমার বাংলাদেশ আমার গর্ব” এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ছাত্রী ‘প্রমি’ বহুল প্রচারিত দৈনিকশিক্ষাডটকম পত্রিকায় তার অনুভূতি ব্যক্ত করেছে ‘সবাই সব বিষয়ে পারদর্শী নয়’ এই বিষয়টি ভাবতে হবে। বিষয় ভিত্তিক মেধা সুযোগ থাকতে হবে। হতে পারে খেলাধুলা, চিত্রকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, ক্ষুদে বিজ্ঞানী, হস্ত ও কারিগরী শিল্প ইত্যাদি। তবেই আমরা এদেশে সব ক্ষেত্রে মেধাবীদের নিয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়তে পারব। আমার বাংলাদেশ আমার গর্ব “এই অনন্য অনুকরণীয় প্রয়াস পৌঁছে যাক বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার সকল উপজেলার শিক্ষার্থীদের কাছে। সোহানা আফসানা প্রমির মতো ওরাও বলবে “আমরা শিক্ষার লক্ষ্যের সঠিক সন্ধান পেয়েছি”। এভাবেই “জঙ্গিবাদ বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে অন্তরঙ্গতা, শিক্ষার্থীর ভিতর সৃজনশীলতা আর কল্পনার বিস্তার ঘটানো সর্বপরি সুনীতি আর মূল্যবোধের সাথে বেড়ে ওঠার প্রত্যয়” এই অঙ্গীকার সফল হবে।

অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেন, “আলোকিত মানুষ চাই”। স্কাউটের জনক বি পি বলে গেছেন “পৃথিবীকে যেমন পেয়েছো তার থেকে আরও একটু সুন্দর রেখে যাওয়ার চেষ্টা করো”। প্রত্যাশা রইল যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার আমিনুল ইসলাম টুকু’র এই নিরন্তর প্রচেষ্টা সকল শিক্ষার্থীর হৃদয়ে স্পন্দিত হোক, ছড়িয়ে পড়–ক সবার হৃদয়ে, চেতনায়। হয়তো কিছু না হোক মনুষ্যত্ববোধ তো জাগ্রত হবে।

কাজী লুৎফুন্নেসা: সম্পাদক, শিশু বিভাগ, যশোর ইনস্টিটিউট, যশোর ([email protected]).

নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030531883239746