মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে প্রত্যাশা - দৈনিকশিক্ষা

মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে প্রত্যাশা

ড. মোহাম্মদ ইউছুফ |

উপমহাদেশে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস অতি প্রাচীন। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিংশ শতাব্দীর সাত দশক পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার ও উন্নয়নের নামে এ দেশে বহু শিক্ষা কমিশন ও কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৯১৪ সালে ইংরেজ সরকার কর্তৃক 'নিউ স্কিম মাদ্রাসা' কোর্স চালু করে। পাকিস্তান আমলে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন এবং কমিটি (১৯৪৯ সালের পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি, ১৯৬৩-৬৪ সালের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন এবং ১৯৭০ সালের শামসুল হক কমিটি ইত্যাদি) গঠিত হয়। এসব কমিশন-কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করলেও তা পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে মাদ্রাসাগুলোতে বাংলা আবশ্যিক বিষয় ছিল না। 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ডাক আসে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মহান বিজয় সূচিত হয় এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। এ কমিশন বাধ্যতামূলকভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার সুপারিশ করে। 

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড মাদ্রাসা পাঠ্যক্রম সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। তৎকালীন সরকারের পক্ষে ১৯৭৫ সালের ২০ জানুয়ারি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মঞ্জুরিপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলোর জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ও সংশোধিত পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবরণের ফলে তার প্রতিষ্ঠিত ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন কর্তৃক পেশকৃত জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ১৯৭৫-পরবর্তী বিভিন্ন সরকার কর্তৃক আধুনিকায়নের নামে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে জেনারেল শিক্ষায় রূপান্তর করার প্রয়াস চালানো হয়। ফলে মাদ্রাসার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও আদর্শ ব্যাহত হয় এবং পরিপূর্ণ আলিম হওয়ার পথ অনেকাংশে রুদ্ধ হয়ে পড়ে। 

১৯৮৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণি থেকে আলিম পর্যন্ত প্রায় একই রকম সিলেবাস বলবৎ ছিল। ১৯৮৫ সাল থেকে দাখিলকে এসএসসি এবং ১৯৮৭ সাল থেকে আলিমকে উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান করে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্নপত্রের ধরন ও সিলেবাসের বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন ও পরিবর্ধনসহ ওই সিলেবাস দীর্ঘদিন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বাংলাদেশের সব আলিয়া মাদ্রাসায় চালু ছিল। 

মাদ্রাসা শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে দেশে একটি ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং মাদ্রাসার ফাজিল ও কামিলকে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের সমমান প্রদানের জন্য আলেম-ওলামা ও ইসলামপ্রিয় জনতা দীর্ঘদিন দাবি করে আসছিল। কালক্রমে এ দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। কিন্তু ২০০৬ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিকে পাশ কাটিয়ে ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্সের মান প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকার কর্তৃক গৃহীত এ সিদ্ধান্তে দেশের ওলামা-মাশায়েখদের ওপর বিষাদের ছায়া নেমে আসে। তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদ্রাসাগুলোকে ন্যস্ত করা হলে মাদ্রাসাগুলোর স্বকীয়তা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে। তারা মনে করেন, প্রতি জেলায় একটি করে মাদ্রাসা নির্বাচন করে মান দেওয়া হলে বাকি মাদ্রাসাগুলো ক্রমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। সে জন্য তৎকালীন আলেম সমাজ 'স্বতন্ত্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফাজিল-কামিলকে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের মান প্রদানের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায়।

এই আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের সব ইসলামী দল ও পীর-মাশায়েখরা একাত্মতা প্রকাশ করলেও সরকারের শরিক দল জামায়াতে ইসলামী এর বিরোধিতা করে। তাদের দাবির মুখে তৎকালীন সরকার ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার অধীনে ফাজিল ও কামিল শ্রেণিকে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের মান ঘোষণা করে। এ ছাড়া দেশের ৩১টি আলিয়া মাদ্রাসায় ফাজিল স্নাতক অনার্স কোর্স চালু করে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কর্তৃক ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৩ বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হলে জাতীয় সংসদ তা পাস করে। এটি মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষার উন্নয়নের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়েছে। যদিও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে যখন পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করবে, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার এক সুবিশাল অঙ্গনে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়।

২০০৯-১৭ পর্যন্ত বর্তমান সরকার মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে বিভিন্ন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ফলে বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এ সম্পর্কে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'মাদ্রাসার উন্নয়নে এই সরকারই সবচেয়ে বেশি কাজ করছে। গত আট বছরে সারাদেশে ১৩৩২টি মাদ্রাসার নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি মাদ্রাসায় গড়ে ৭০ লাখ টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। নতুন আরও দুই হাজার মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে।' 

শিক্ষা ব্যবস্থায় গতিশীলতা সঞ্চার ও যুগোপযোগী করার জন্য শিক্ষাক্রম উন্নয়ন-পরিমার্জন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ প্রণয়ন করে। 

বর্তমান সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার বিদ্যমান সমস্যার সমাধান ও আধুনিকায়নে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপন, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি প্রভৃতি। ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদানের বিষয় এবং কওমি শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১১ এপ্রিল ২০১৭ গণভবনে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামদের এক অনুষ্ঠানে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ইসলামী শিক্ষা এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা, যা অর্জন করলে একজন মানুষ ইসলামের মৌলিক জ্ঞান লাভ করতে পারে। ইসলামের বিভিন্ন দিক বিভাগ ও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি এবং তদনুযায়ী জীবন গড়তে সক্ষম হয় এমন যোগ্য আলেম সৃষ্টি করাই হলো মাদ্রাসা শিক্ষার আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। এই মূলনীতি এবং দর্শনের আলোকে মাদ্রাসা শিক্ষা আরও সংস্কার করতে হবে। 

মাদ্রাসা শিক্ষাকে নানাভাবে আধুনিকায়নের চেষ্টা চলছে ঠিকই; কিন্তু এখনও পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষা না যথার্থ থিয়োলজিক্যাল শিক্ষার ভিত্তিতে হচ্ছে, না যথার্থ আধুনিক শিক্ষা হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন জরুরি। তবে এর মানে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় রূপান্তরিত করা নয়। বরং মাদ্রাসা শিক্ষাকে বর্তমান যুগের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ এবং গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করা, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত না হয়ে ইসলামী কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক কার্যক্রমে অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, আরবি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সমকাল

সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ - dainik shiksha শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032088756561279