শিক্ষকরা অযথা চিৎকার করছেন, এনসিটিবিমাধ্যমিক শ্রেণির নতুন রুটিনে হিমশিম

রুম্মান তূর্য |

মাধ্যমিকের নতুন রুটিনে ক্লাস চালাতে স্কুলগুলো হিমশিম খাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। নতুন রুটিনে শিশুদের খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের সময় মিলছে না বলে জানিয়েছেন তারা। এক শিফট ও দুই শিফটের স্কুলগুলোতে ক্লাসের সময় বাড়ানো হয়েছে দাবি করে শিক্ষকরা তা নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, সময় বাড়ানোয় আনন্দমুখর শিক্ষার পরিবেশ বিষাদময় হয়ে যাচ্ছে। 

অপর দিকে দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রভাতী শাখার ছুটির সঙ্গে সঙ্গে একই সময়ে দিবা শাখার ক্লাস শুরুর নির্দেশনা থাকায় তা ‘অবাস্তব’ বলে আখ্যায়িত করছেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। তারা বলছেন, এক শিফটের ছুটির পর অপর শিফটের ক্লাস শুরু করতে ১০ মিনিট সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু সে সময় না থাকায় সরকারের দেয়া রুটিন মেনে শতভাগ ক্লাস নেয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক স্কুলে অতিরিক্ত শিক্ষক না থাকায় রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নিতে পারছেন না বলেও জানিয়েছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা রুটিন সংশোধনের অনুরোধ জানিয়েছেন।

যদিও রুটিন প্রণয়নে জড়িত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্কক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তারা বলছেন, নতুন রুটিনে সময় বাড়ানো হয়নি। আগের কারিকুলামের ক্লাসের সময়ই নতুন রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা আগে অনৈতিকভাবে কম সময় ক্লাস চালিয়েছেন। শিখন ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার কথা থাকলেও তা নতুন রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শিক্ষকরা একদিন বেশি ছুটি পেয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নতুন রুটিনে ক্লাস চালাতে শিক্ষকদের আপত্তি তোলা অমুলক মন্তব্য করেছেন এনসিটিবি কর্তারা।

এদিকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে মাধ্যমিকে ক্লাস বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। এক এনজিও কর্তা বলেছেন, ‘ক্লাসের সময় বাড়ানোয়’ করোনার শিখন ঘাটতি দূর হবে। 

জানা গেছে, নতুন রুটিনে সব সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে ছয় পিরিয়ড করে ক্লাস হবে। আর নবম ও দশম শ্রেণিতে ক্লাস হবে সাত পিরিয়ড। নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন ক্লাস রুটিনের সঙ্গে সমন্বয় করে এভাবে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ক্লাস নিতে স্কুলগুলোর জন্য রুটিন প্রস্তুত করেছে এনসিটিবি। এনসিটিবির করা ওই রুটিন অনুযায়ী স্কুলগুলোকে ক্লাস চালাতে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। 
নতুন রুটিন অনুসারে, এক শিফটের স্কুলগুলোর ক্লাস সকাল দশটায় শুরু হয়ে চলবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বলছেন, আগে এক শিফটের স্কুলের ক্লাস চলতো সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। আর দুই শিফটের স্কুলগুলোর প্রভাতী শিফটের ক্লাস সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হয়ে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আর দিবা শাখার ক্লাস চলবে বেলা সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল পৌনে ছয়টা পর্যন্ত। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বলছেন, তারা আগে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ১২টা পর্যন্ত প্রভাতী শাখার ও দিবা শাখার ক্লাস চলতো সাড়ে ১২টা থেকে সোয়া ৫টা পর্যন্ত। 

এ পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা ক্লাসের সময় বাড়ানোয় আপত্তি জানিয়েছেন। মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদের সভাপতি ও মুন্সীগঞ্জের লৌহজং গার্লস পাইলট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নৃপেন্দ্র চন্দ্র দাস দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, নতুন রুটিনে দীর্ঘ সময় ক্লাসে বাচ্চাদের রাখা কঠিন হয়ে গেছে। শিক্ষকরাও দীর্ঘ সময় স্কুলে থাকতে চাচ্ছেন না। দীর্ঘ সময় ক্লাস চালানোয় শিক্ষার্থীদের মনোযোগও থাকবে না। এক শিফটের স্কুলে সকাল দশটা থেকে ক্লাস শুরু হলেও শিক্ষকদের নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে স্কুলে আসতে হচ্ছে। আর পাঁচটায় ছুটি হলেও বাড়ি যেতে যেতে বাজছে সাড়ে পাঁচটা। আর ক্লাস ছাড়াও শিক্ষকদের নানা কাজ করতে হয়। তাদের শিখন কন্টেন্ট তৈরি করতে হয়। সব মিলিয়ে দীর্ঘ সময় ডিউটি করতে হয়। শিক্ষকরা তা করতে চাচ্ছেন না।  

তিনি বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ক্লাস নির্ধারণ করে দেয়ায় কিছু জটিলতা হচ্ছে। যেমন রোববার প্রথম পিরিয়ডে সপ্তম শ্রেণির গণিত ক্লাস নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠানে শাখা আছে তিনটি। প্যাটার্নভুক্ত গণিত শিক্ষক আছেন একজন। তাই তিন শাখায় একজন গণিত শিক্ষককে পাঠানো যাচ্ছে না। এর পর আমার অষ্টম, নবম, দশম আরো তিনটি শ্রেণি আছে। বাধ্য হয়ে অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের বাকি দুই শাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত শিক্ষক না থাকা স্কুলগুলো নতুন রুটিন মানতে হিমশিম খাচ্ছে। 

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও রাজধানীর বিটিসিএল আইডিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মজিবুর রহমান বাবুল দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, নতুন রুটিনে বাচ্চারা খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের সময় পাচ্ছেন না। রুটিনে ক্লাসের সময় বাড়ানোয় শিক্ষকরাও আপত্তি জানিয়েছেন। আবার সাড়ের ১২টায় প্রভাতী শাখা ছুটি দিয়ে সাড়ে ১২টায় দিবা শাখার ক্লাস শুরু করতে বলেছে- যা অবাস্তব। এক শিফটের বাচ্চারা বের হয়ে যাওয়ার পর অন্য শিফটের বাচ্চাদের ক্লাসে বসতে হলেও কিছুটা সময় লাগে। কাগজে কলমে এ নির্দেশনা দেয়া গেলেও বাস্তবে তা মানা যাচ্ছে না। প্রধান শিক্ষকের মতে নতুন রুটিনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় একাগ্রতা নিয়ে সমস্যা হতে পারে ও উপস্থিতির হার কমে যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ঘেয়েমি চলে আসতে পারে। পড়াশোনার প্রতি ভয়ও চলে আসছে। 

নওগাঁর পত্নীতলার সুবরাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অহিদুল ইসলাম দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, বাসা থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার দূরে স্কুল। আগের রুটিনে ক্লাস চলাতে বাসা থেকে বের হতে হতো সকাল ৮টার দিকে আর বাসায় ফিরে পৌঁছতাম ৬ টার দিকে।  কিন্তু এই নতুন রুটিনে সকাল ১০ টায় ক্লাস শুরু করতে হচ্ছে। এর আগে করতে হচ্ছে প্রাত্যহিক সমাবেশ। এজন্য স্কুলে পৌঁছতে হচ্ছে সকাল সাড়ে ৯ টার আগে। সকাল সাড়ে ৭টায় বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে। ফিরছি সন্ধ্যা ৭টায়। এতো দীর্ঘ সময় শ্রেণিতে পাঠদান করতে বিরক্তি লাগে। শিক্ষার্থীদের মাঝেও ক্লাসে অনিহা দেখা যাচ্ছে। 

মাধ্যমিকের নতুন রুটির প্রণয়নে সম্পৃক্ত ছিলেন এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে দৈনিক আমাদের বার্তাকে তিনি বলেন, শিক্ষকরা যেসব অভিযোগ তুলেছেন তা অমুলক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের কারিকুলামে যে সময় ছিলো, নতুন রুটিনেও সে সময়ে ক্লাস নিতে বলা হয়েছে। শিক্ষকরা অনৈতিকভাবে এতোদিন ক্লাস চালাচ্ছিলেন। আর যতোটুকু সময় ক্লাস নিতে বলা হয়েছে ততোটুকু সময় ক্লাস না নিলে ইন্টারন্যাশনালি তা রিকগনাইজড হবে। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে সময় আগে নির্ধারণ করা হয়েছিলো, এখনো করা হয়েছে। সময় বাড়ানোর যে কথা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। 

তিনি আরো বলেন, শিক্ষকরা যে বিষয়গুলো নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন তা অমূলক। স্কুল খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি করবো, কিন্তু শিক্ষক থাকবে না এটা হতে পারে না। নতুন রুটিনে ক্লাস চালাতে অতিরিক্ত শিক্ষকের প্রয়োজন হবে না। অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলে তাদের জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা। 

তিনি আরো বলেন, প্রভাতী শাখার ক্লাস শেষ ও দিবা শাখার ক্লাস শুরুর যে সমস্যা সেটি ঠিক আছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শনিবারও ছুটি ঘোষণা করায় শিক্ষকরা এক দিন বেশি ছুটি পেয়েছেন। আমরা শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি দূর করতে একটি অতিরিক্ত পিরিয়ডের কথা ভাবছিলাম। কিন্তু তাও দেয়া হয়নি। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা ‘লেইম

এক্সকিউজ’ দিয়ে অযথা চিৎকার করছেন। আমি আশা করবো বিষয়গুলো অনুধাবন করে নতুন রুটিনে ক্লাস চালাবেন।
এদিকে স্কুলে ক্লাসের সময় বাড়ানোকে সাধুবাধ জানিয়েছেন ব্র্যাকের গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। সম্প্রতি একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি বলেছেন, মাধ্যমিকের ক্লাসের সময় বাড়ানোয় শিক্ষার্থীদের করোনায় সময়ের শিখন ঘাটতি দূর হবে।

 

সাবেক গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীন আর নেই - dainik shiksha সাবেক গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীন আর নেই ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করের বিধান বাতিল চায় সিপিডি - dainik shiksha ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করের বিধান বাতিল চায় সিপিডি স্কুল ফাঁকি দিয়ে পার্কে আড্ডা দেয়া ৬০ শিক্ষার্থী আটক - dainik shiksha স্কুল ফাঁকি দিয়ে পার্কে আড্ডা দেয়া ৬০ শিক্ষার্থী আটক স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের মে মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের মে মাসের এমপিওর চেক ছাড় এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার বদলে ছয় ছাত্রী বিয়ের পিঁড়িতে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার বদলে ছয় ছাত্রী বিয়ের পিঁড়িতে লিফট কিনতে পাবিপ্রবির প্রতিনিধি দলের তুরস্কে যাওয়া স্থগিত - dainik shiksha লিফট কিনতে পাবিপ্রবির প্রতিনিধি দলের তুরস্কে যাওয়া স্থগিত সর্বজনীন পেনশন চালু হলে টাকা রাখার জায়গা পাব না : অর্থমন্ত্রী - dainik shiksha সর্বজনীন পেনশন চালু হলে টাকা রাখার জায়গা পাব না : অর্থমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060791969299316