মানুষ গড়ার কারিগর - দৈনিকশিক্ষা

মানুষ গড়ার কারিগর

ড. এস এম ইমামুল হক |

শিক্ষকতা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পেশা। শিক্ষাদানের মহান ব্রত নিয়ে কাজ করেন একেকজন আদর্শ শিক্ষক। সবাই আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন না। এটি অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদের যোগ্য করে গড়ে তোলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের জীবন ও যুগোপযোগী শিক্ষা দেবেন। তাদের জ্ঞান অর্জনের পথ দেখাবেন, আলোর পথের যাত্রী করবেন। শিক্ষার্থীদের ভেতর জ্ঞান লাভ, অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা এবং চেনা-জানা বিষয়গুলোকে নতুন করে চেনার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেবেন। উৎসাহ, প্রেরণা, শক্তি জোগাবেন। ভালো-মন্দ, ভুল-সঠিকের দৃষ্টিভঙ্গি শেখাবেন। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন।

শুধু পুঁথিগত বিদ্যা বিতরণ নয়; মানুষ হয়ে উঠতে ছাত্রছাত্রীদের যা যা প্রয়োজন, সব শিক্ষা দেওয়া একজন শিক্ষকের কর্তব্য। তিনি ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে বলবেন, রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করবেন, দেশপ্রেমের শিক্ষা দেবেন। তাই শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গঠনের কারিগর। পাঠদানের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা, তাদের গাইড করাও শিক্ষকের দায়িত্ব। সকালবেলা যাব, বিকেলে ফিরব, মাস শেষে বেতন নেব- এর নাম শিক্ষকতা নয়। এর বাইরেও শিক্ষকদের অনেক কিছু করতে হয়। যার জন্য চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্ন থাকবে না। তাই শিক্ষকতা শুধু একটা পেশা নয়; একটি ব্রত। বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষকের মধ্যে এই চিন্তাটা নেই। তারা ভাবেন, এটা করে আমার কী লাভ? আমি কেন করব? শিক্ষকতা করতে গিয়ে সব সময় অর্থের চিন্তা করলে এ পেশায় না আসাই ভালো।

অনেকের ধারণা, শিক্ষকতা একটি সহজ পেশা। আসলে এটি সবচেয়ে কঠিন। একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবেন, তার প্রস্তুতি নিতে হয়; ছাত্রদের সম্পর্কে চিন্তা, গবেষণা ও লেখালেখি করতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাদেরও চাহিদা বাড়ছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে শিক্ষকদেরও আপডেট থাকতে হবে। শিক্ষকতায় নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্বদের অনেক সময় ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে বিসর্জন দিতে হয়। আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যেসব বিষয় শিক্ষার্থীরা বাসায় কিছু বলতে পারে না, সেগুলো অকপটে শিক্ষকের কাছে বলতে পারে। সে কারণে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক মধুর হওয়া দরকার। আমরা যতই বলি, শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ভালো না হলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হবে না, ছাত্ররা প্রকৃত শিক্ষা পাবে না। একজন শিক্ষক ছাত্রের গাইড। সুতরাং তাকে সেভাবে ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। ছাত্ররা যেন বোঝে :মা-বাবার পরেই শিক্ষকের স্থান। শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। তাই শিক্ষকের উচিত নিজের গুণাবলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। তাদের এমন কিছু করা উচিত নয়, যা নেতিবাচক।

শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের রোল মডেল বা আদর্শ পথপ্রদর্শক। একজন আদর্শ শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের জীবন আমূল বদলে দিতে পারেন। তাদের নবজন্ম দিতে পারেন। শিক্ষকদের অতুলনীয় অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ১৯৯৪ সাল থেকে ৫ অক্টোবর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৬ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত 'শিক্ষকদের মর্যাদা' শীর্ষক সম্মেলনে গৃহীত এবং ইউনেস্কো ও আইএলও কর্তৃক স্বাক্ষরিত সুপারিশমালায় শিক্ষক দিবস পালনের জন্য ৫ অক্টোবর তারিখটি নির্ধারিত হয়। এ দিনটি শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দিন; তাদের অবদানকে স্মরণ করার দিন। জাতিসংঘ স্বীকৃত ১৯৩ দেশের মধ্যে শতাধিক দেশ বিশ্ব শিক্ষক দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছে।

সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (১৯৪৮) ৭০তম বার্ষিকী উদযাপনের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে এ বছর সাড়ম্বরে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসের আয়োজন করা হয়েছে। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য- The right to education means the right to a qualified teacher. শিক্ষার অধিকার মানে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অধিকার। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়- শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হবে না। যোগ্য শিক্ষকও একটি বড় ফ্যাক্টর। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, দুনিয়াজুড়েই যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের বড়ই অভাব। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো পর্যায়ে সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের গড়ার উত্তম জায়গা স্কুল। সেখানে যোগ্য শিক্ষক নেই বললেই চলে। অনেক দেশে সবচেয়ে ভালো ফলধারীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এর কারণও আছে। শিক্ষকরা সেখানে অনেক সম্মানী পান। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও সামাজিক অবস্থান বাড়ানো না গেলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

শ্রেণিকক্ষের বাইরেও ছাত্রদের সঙ্গে একজন শিক্ষকের যোগাযোগ থাকা উচিত। কোনো ছাত্র হয়তো লেখালেখিতে ভালো, তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কেউ ভালো গান গায়, কেউ খেলাধুলায় ভালো, কেউ বিতর্ক করতে পছন্দ করে। এসব বিষয়ে শিক্ষকদের গাইড করতে হবে। তাই ক্লাসরুম ও ক্লাসরুমের বাইরে; দুই জায়গাতেই শিক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা থেকে যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। শিক্ষকদের অবশ্যই বন্ধুবৎসল হওয়া উচিত; কিন্তু বন্ধু নয়। অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশি খোলামেলা হয়ে যান। আমি মনে করি, এটি ঠিক নয়। তবে ছাত্রদের সঙ্গে কখনও আনফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ার করা উচিত নয়। মাস্টার্স লেভেলে শিক্ষার্থীরা ম্যাচিউরড হয়, তারা অনেক কিছু বোঝে। তখন তাদের সঙ্গে অনেকটাই ফ্রেন্ডলি হওয়া যায়, অনেক কথা বলা যায়।

অনেক শিক্ষক শুধু পাঠদানের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন। একজন ছাত্র হয়তো মানসিক অশান্তিতে ভুগছে, ফল খারাপ করছে। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। মাদকাসক্ত হতে পারে, পারিবারিক সমস্যা থাকতে পারে, অর্থনৈতিক সমস্যা থাকতে পারে, প্রেমঘটিত বিষয় থাকতে পারে। এর কারণ খুঁজে বের করা শিক্ষকের দায়িত্ব। আমি আমার কলিগদের বলি, ক্লাস এক ঘণ্টা হলে সেখানে অন্তত ১০ মিনিট রাখতে হবে, যেখানে বইয়ের বাইরের কথা বলা হবে। এতে ছাত্ররা শিক্ষকদের অনেক কাছে চলে আসে। সমস্যার কথা বলার সাহস পায়। একজন ছাত্র অনেক কথা মা-বাবাকে বলতে পারে না। শিক্ষকরা সহানুভূতিশীল ও বন্ধুসুলভ হলে ছাত্রছাত্রীরা তাদের কাছে অনেক মনের কথা বলতে পারে। শিক্ষক অনেক সমস্যার সমাধান দিতে পারেন। এ কারণেই শিক্ষার্থীদের কাছে রোল মডেল হন শিক্ষকরা। 

কোনো কোনো শিক্ষক মূল্যবোধ ভুলে গিয়ে, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ছাত্রদের শুধু অর্থোপার্জনের জন্য ব্যবহার করছেন। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায় করছেন। কিছু স্কুল-কলেজ শিক্ষক আছেন, যারা বলেন, আমার কাছে প্রাইভেট না পড়লে নম্বর পাবে না। যাকে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়, তিনি তার নীতি ভুলে ছাত্রদের পাস করার শর্টকাট উপায় বলে দিচ্ছেন। ঘটছে প্রশ্ন ফাঁসের মতো বড় অপরাধ। এসব কারণে শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধাবোধ কমছে। ছাত্রছাত্রীরা এই যে ঋণাত্মক মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠছে, সেটার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে মনোবিন্যাস বদলানো দুস্কর। 

স্কুল শিক্ষকদের কথা আমার এখনও মনে আছে। তারা আমাদের শুধু পড়াতেন না; শেখাতেনও। আর এখন শুধু পড়ানো হয়, শেখানো নয়। শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়ের পেছনে আর্থিক অসচ্ছলতাও খানিকটা দায়ী। শিক্ষকতাকে শুধু মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই হবে না, বরং তা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারেন। আজ আমরা মানসম্মত শিক্ষার কথা বলছি। এ জন্য সর্বাগ্রে দরকার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক। আর সব পর্যায়ে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক পেতে এ পেশার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো জরুরি।

 

লেখক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030200481414795