পুলিশের বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমান এবং দুদকের পরিচালক (সাময়িক বরখাস্ত) খন্দকার এনামুল বাছিরের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে দুদক। একই সঙ্গে মিজানের স্ত্রী, দুই সন্তান এবং ভাই ও ভাগ্নের হিসাব সম্পর্কেও তথ্য চাওয়া হয়েছে।
এজন্য রোববার ও মঙ্গলবার আলাদাভাবে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি দেয় দুদক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও একই ধরনের চিঠি দেয়া হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট দিতে অনুরোধ জানানো হয়। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মিজান মালিক।
এদিকে দু’জনের ঘুষের লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য রোববার বিশেষায়িত সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেলে (এনটিএমসি) পাঠিয়েছে দুদক।
ফরেনসিক রিপোর্ট আসার পর দু’জনের কণ্ঠস্বর এক হলে বা কথোপকথন মিলে গেলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কমিশনে সুপারিশ করবে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান টিম। এর অংশ হিসেবে দু’জনকে ঘুষের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এমনকি পরীক্ষায় প্রমাণ সাপেক্ষে দু’জনের বিরুদ্ধে মামলারও সুপারিশ করবে কমিটি।
জানা গেছে, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ, ঘুষ কেলেঙ্কারি, তথ্য গোপন করে রাজউকের প্লট নেয়াসহ একাধিক বিষয়ে নতুন তথ্য পেয়েছে এ সংক্রান্ত দুদকের বর্তমান অনুসন্ধান টিম। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। আগামী সপ্তাহেই মামলাগুলো দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক।
এ ছাড়া পুলিশ সদর দফতরের উচ্চপর্যায়ের একটি টিম আলাদাভাবে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে নতুন করে ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে নেমেছে।
এর আগে সদর দফতরের অপর একটি কমিটির তদন্তে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অর্ভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দুদকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ডিআইজি মিজানের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লেনদেনের বেশকিছু তথ্য দুদকের হাতে পৌঁছেছে।
এতে দেখা গেছে, মিজান ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেশির ভাগ অর্থই তুলে নিয়েছেন। একটি হিসাবে জমা আছে মাত্র ২ হাজার টাকা। আরেকটিতে ৫০ হাজার টাকা। অনেক হিসাবেই তেমন টাকা নেই। তার স্ত্রী, ছোট ভাই ও ভাগ্নের হিসাবের তথ্য আজ এসে পৌঁছাতে পারে।
এছাড়া খন্দকার এনামুল বাছিরের ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত তথ্যও দু-একদিনের মধ্যেই দুদকে আসতে পারে। সমুদয় তথ্য হাতে আসার পর সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে অনুসন্ধান টিম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিমের প্রধান মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, অনুসন্ধান শেষ হওয়ার আগে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
এর আগে দুদকের পরিচালক (সাময়িক বরখাস্ত) খন্দকার এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে ২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মামলার সুপারিশ করেছিলেন। এরপরই দু’জনের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হয়। এতে এনামুল বাছির সাময়িক বরখাস্ত হন।
পরে নতুন করে দুদকের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করে কমিশন। ওই টিমকে সাত দিন সময় দেয়া হয় প্রতিবেদন দাখিলের জন্য।
আজ বৃহস্পতিবার তাদের সেই সময়সীমা শেষ হচ্ছে। ইতিমধ্যে বর্তমান অনুসন্ধান টিম ডিআইজি মিজানের আরও বেশি অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে। আগের পরিচালক শুধু ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছিলেন।
বর্তমান টিম মিজানের এক ভাই ও ভাগ্নেকেও সহযোগী আসামি করার (পুলিশের এসআই) সুপারিশ করতে পারে। এর আগেও মিজানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছিল দুদক। তখন উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
কিন্তু মিজানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর সরানো হল এনামুল বাছিরকে।
মিজানের ভাগ্নে পুলিশের এসআই মাহমুদুল হাসানের নামে কেনা কাকরাইলের বাণিজ্যিক ফ্ল্যাটটি গোপনে বিক্রি করে দিলেও দুদক টিম সেই ফ্ল্যাটের দলিল রেজিস্ট্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এছাড়া তার বিদেশ গমনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে ।
জানা গেছে, ডিআইজি মিজানের নামে পূর্বাচল নতুন প্রকল্পে ৫ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। এর বিপরীতে তিনি সরকারি রেট অনুযায়ী কাঠাপ্রতি ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা করে ৫ কাঠার টাকাও জমা দেন।
এই প্লটের জন্য ডিআইজি মিজান যে হলফনামা দাখিল করেন, তাতে রাজধানীতে নিজের নামে কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট নেই মর্মে দাবি করলেও তার পোষ্য বা স্ত্রী-সন্তানের নামে কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট আছে কিনা সে কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি।
অথচ নিয়মানুযায়ী রাজউক থেকে এভাবে প্লট নিতে হলে হলফনামায় স্পষ্ট ঘোষণা দিতে হয়, রাজধানীতে আবেদনকারীর নিজের নামে বা পোষ্য কারও নামে কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট নেই। দুদক মনে করছে, তিনি এ ক্ষেত্রে চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন। এ বিষয়ে তথ্য জানতে রাজউকের কাছেও চিঠি দিয়েছে দুদকের টিম।
অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর পরিচালক এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের বক্তব্য নিয়েছিলেন। এমনকি তার স্ত্রী রত্নার বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করেন। ডিআইজি মিজানের ভাগ্নে ও ভাইয়ের নামে সম্পদ করায় তাদেরও বক্তব্য নেন। পরে তিনি ২৩ মে কমিশনে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এতে বলা হয়, ৪ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার টাকার সম্পদ ডিআইজি মিজানের দখলে রয়েছে । এর মধ্যে তার নিজের নামে ১ কোটি ১০ লাখ ৪২ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৯৬ লাখ ৯২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।
এছাড়া ছোট ভাই মাহবুবুর রহমানের নামে তার নিজের সম্পদ রয়েছে ৯৫ লাখ ৯১ হাজার টাকার। আর ভাগ্নে পুলিশের এসআই মাহমুদুল হাসানের নামে রয়েছে তার ১ কোটি টাকার সম্পদ।
সব মিলিয়ে দলিল মূল্যে ডিআইজি মিজানের সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার টাকার। এর মধ্যে তার আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৯০ লাখ ৭৮ হাজার টাকার। আর ব্যয় পাওয়া যায় ৮৫ লাখ ১২ হাজার টাকার। আয়-ব্যয় বাদ দিয়ে ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৯৭ লাখ ২১ হাজার টাকার।
তার এই আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের দুদক আইনের ২৬(২) ও ২৭(১) ধারাসহ ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইনের ৪(২) ধারায় মামলার সুপারিশ করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাছির।
সূত্র জানায়, এই রিপোর্ট দাখিলের পরই ডিআইজি মিজান দুদক পরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে হাজির হন। তিনি অভিযোগ করেন, পরিচালক এনামুল বাছির তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। ৫০ লাখ টাকার লেনদের কথা থাকলেও ৪০ লাখ টাকা তিনি দিয়েছেন।
দুদকের মামলা থেকে রক্ষা পেতে তিনি চলতি বছর জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ এই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে রমনা পর্কে দুদক পরিচালককে এই ঘুষ দেন। কিন্তু এরপরও তার বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেন ওই পরিচালক।
বাছিরের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর দুদক সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে কমিশন। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পরিচালক এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করে কমিশন।
একই সঙ্গে তার কাছ থেকে অনুসন্ধানের যাবতীয় নথিপত্র নিয়ে নেয় কমিশন। নিয়োগ দেয়া হয় পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি। ওই কমিটি গত সাত দিনে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান করে আগের সম্পদের চেয়ে আরও বেশি সম্পদের তথ্য বের হয়।