মিঠাপানির কীর্তনখোলা-সুগন্ধা নদীতে হঠাৎ লবণাক্ততা | বিবিধ নিউজ

মিঠাপানির কীর্তনখোলা-সুগন্ধা নদীতে হঠাৎ লবণাক্ততা

কয়েক দিন ধরে বরিশাল নগরী সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর পানিতে লবণাক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। নদী তীরবর্তী মানুষ কয়েক দিন আগে দৈনন্দিন কাজে এ নদীর পানি ব্যবহার করলেও এখন তা স্বাভাবিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। আর মিঠাপানির কীর্তনখোলা নদীতে বর্তমানে যে কিছুটা লবণাক্ততা রয়েছে তা নিশ্চিত করেছেন পরিবেশবিদরাও। বিশেষ ক

কয়েক দিন ধরে বরিশাল ও ঝালকাঠীর কীর্তনখোলা ও সুগন্ধা নদীর পানিতে লবণাক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। নদী তীরবর্তী মানুষ কয়েক দিন আগে দৈনন্দিন কাজে এ নদীর পানি ব্যবহার করলেও এখন তা স্বাভাবিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। আর মিঠাপানির কীর্তনখোলা নদীতে বর্তমানে যে কিছুটা লবণাক্ততা রয়েছে তা নিশ্চিত করেছেন পরিবেশবিদরাও। বিশেষ করে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কীর্তনখোলা নদীর পানিতে তড়িৎপরিবাহিতা (ঊষবপঃৎরপধষ ঈড়হফঁপঃরারঃু-ঊঈ) অনেক কম থাকলেও মার্চ মাসে বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এমনকি গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে পানির তাপপাত্রাও বেড়েছে। আর এসব হিসাবে গেল বছর করোনাকালে বেশ ভালো ছিল এই নদীর পানি।

বিশেষজ্ঞদের মতে শুষ্ক মৌসুমে উজানের পানি কম প্রবাহিত হওয়া এবং সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হওয়া, দূষণসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই কীর্তনখোলার মতো মিঠা নদীর পানিও এখন লবণাক্ত হয়ে উঠেছে। এতে করে জীববৈচিত্র্যের ওপরও বিরুপ প্রভাব পড়বে, ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কাও রয়েছে।

বরিশাল নগরের ভাটারখাল কলোনির বাসিন্দা যারা কীর্তনখোলা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল তাদের মতে, সপ্তাহখানেকেরও বেশি সময় ধরে কীর্তনখোলা নদীর পানিতে লবণের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মুক্তিযোদ্ধা পার্ক সংলগ্ন নদীতে গোসল করতে গিয়ে অনেকেই পানি মুখে দিয়ে লবণের উপস্থিতি লক্ষ করেন। প্রথমে বিষয়টি নিয়ে কেউ ভ্রƒক্ষেপ না করলেও, ডিসি ঘাট থেকে স্থানীয় দোকানিরা চায়ের পানি সংগ্রহ করতে গেলে তাতেও লবণের উপস্থিতি লক্ষ করেন। এর পর থেকেই কীর্তনখোলা নদীর পানি হঠাৎ করেই লবণাক্ত হওয়ার বিষয়টি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বেশ শোরগোল শুরু হয়ে যায়। কোস্টগার্ড জেটি সংলগ্ন এলাকার চায়ের দোকানি সোহেল রানা জানান, প্রথমে নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে ওঠার কথা ছোট ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে শুনেছেন। পরে তিনি নিজেও মুখে পানি নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন।

স্থানীয় বাসিন্দা জসিম জানান, প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল শহরের ভেতর থেকে বয়ে আসা খালের মুখের পাশের জায়গাতে নদীর পানি লবণাক্ত। তাই এটা স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল অনেকে। পরে বিভিন্ন স্থান থেকে নদীর পানি লবণাক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এক চায়ের দোকানি একদিন নদী থেকে পানি এনে চা বানাতে গিয়ে তাতে লবণের উপস্থিতি পেয়ে ফেলে দিতে বাধ্যও হন।

স্থানীয় যুবকরা বলছেন, শুধু পানি লবণই নয়, গোসল করার পর চুলগুলো কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে, যা আগে হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ও বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম জানান, ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তারা একটি সার্ভে করেছিলেন, যেখানে দেখতে পান শুষ্ক মৌসুমে সাগরের পানি তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত চলে আসছে। তখন পরিবেশ অধিদফতরসহ দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে বিষয়টি নিয়ে ভাবার জন্য বলা হয়েছিল।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বেশ কিছু মাধ্যমে শুনতে পাচ্ছি কীর্তনখোলা নদীর পানিতে লবণাক্ততার উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য পরিবেশ অধিদফতরকে কীর্তনখোলা নদীর পানি পরীক্ষা করতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ যেটুকু নেয়া প্রয়োজন তা নিতে হবে। তা না হলে আমাদের জলজ সম্পদের ক্ষতি হবে, পাশাপাশি মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর বিরুপ প্রভাব পড়বে এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরুপ প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, এখন থেকে ১০ বছর আগে উজানের যে পানি আসত নদীগুলোতে এখন তা কমে আসছে। আর আমাদের এখানে যখন পানির পরিমাণটা কমবে তখন সাগর থেকে ওই পানির চাপটা ঠিকই আসবে। এটা কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিরূপ প্রভাব। ফলে উজানের পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু অভিযোজনের জন্য যা যা করা দরকার সেটি করতে হবে। সেই সাথে আমাদের মানুষদেরও সচেতন হতে হবে।

তবে সবকিছুর আগে কীর্তনখোলায় লবণ পানির যে বিষয়টি শোনা যাচ্ছে সেটিকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করতে হবে। আর এটা নিয়মিত পরিবেশ অধিদফতর করে থাকে। তারা পরীক্ষা করে পানির মানের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে।

প্রতি মাসেই নদীর পানি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী বায়োকেমিস্ট মো: মুনতাসির রহমান। তিনি বলেন, পরীক্ষার হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মার্চ মাসে কীর্তনখোলা নদীর পানির অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কীর্তনখোলা নদীর ছয়টি স্পট থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করে পানিতে তড়িৎপরিবাহিতা ৩১৪ থেকে ৩৪০ মাইক্রোসিমেন্স পার সেন্টিমিটার পাওয়া গেছে। এর আগে তিন থেকে চার শত মাইক্রোসিমেন্স পার সেন্টিমিটারের মধ্যেই পাওয়া যায়। সেখানে মার্চ মাসে পাওয়া গেছে ১৩৩১-১৩৬২ পর্যন্ত, যা মানদণ্ডের থেকেও অনেক বেশি। এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়, তাই নিয়মিত মনিটরিং রাখা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে অধিকতর বিশ্লেষণ করে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হবে।

এ দিকে পরীক্ষায় ফেব্রুয়ারি মাসের থেকে মার্চ মাসে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও, অম্লতা এবং ক্ষারের পরিমাণ নির্দেশ করা পিএইচের পরিমাণ ঠিক ছিল।

পরিবেশ অধিদফতরের রিপোর্টের বরাত দিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে লবণাক্ততা কয়েক গুণ বেড়েছে। নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এ কারণেই উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলের সব এলাকার নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। আর এ বছর সেই সাথে যোগ হয়েছে এখনো বৃষ্টি না হওয়া। বৃষ্টিপাত হলে স্বাভাবিকভাবেই স্যালাইনিটি লেভেল কমে যেত।

তিনি বলেন, উজান থেকে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা সে পরিমাণ না আসলে সমুদ্রের পানিটা বাইব্যাক করে নদীতে চলে আসে। তখন লবণাক্ততার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে। তবে দুই মাসের পরীক্ষার ফলাফল এটা নিশ্চিত করে বোঝায় না যে, এটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। আমাদের আর একটু সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি তড়িৎপরিবাহিতা (ঊষবপঃৎরপধষ ঈড়হফঁপঃরারঃু-ঊঈ) বেড়ে যাওয়াতে কী ধরনের ক্যামিক্যাল কম্পোজিশনগুলো বেড়েছে সেগুলোও জানতে হবে, তাহলে বোঝা যাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ।

তবে লবণাক্ততা বেড়ে গেলে নদীতে বসবাসকারী প্রাণীর গ্রোথ হ্যাম্পার হবে। পাশাপাশি অনেক প্রজাতি হারিয়ে যেতে পারে। ইলিশসহ নানা ধরনের মাছের উৎপাদনেও প্রভাব ফেলতে পারে, তবে সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কামরুজ্জামান সরকার জানান, প্রতি মাসেই কীর্তনখোলাসহ বরিশাল বিভাগের ১৫টি নদীর পানি পরীক্ষা করা হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পানির পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলে তড়িৎপরিবাহিতা ও স্যালাইনিটির প্যারামিটারগুলো সীমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু মার্চ মাসে ড্রামাটিক্যালি তড়িৎপরিবাহিতার মান অনেক বেড়ে গেছে। আমরা বিষয়গুলো লক্ষ করছি, ঘন ঘন পানির স্যাম্পল সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হবে। তবে এখনই বলা যাবে না যে, অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ কীর্তনখোলা নদীতে সে ধরনের বিশাল কিছু হয়ে গেল। আর আমরাও বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব।

তবে এমন সমস্যা নদীর স্বাভাবিক পবাহ বাধাগ্রস্ত হলেও হতে পারে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখার আহ্বান তাদের।