বহুল আলোচিত মিতু হত্যা মামলায় স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তারকে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আটক করেছে। বাবুলই স্ত্রী মিতু হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে পিবিআই’র তদন্তে উঠে এসেছে। সংস্থাটির একটি সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। অথচ হত্যাকা-ের পর বাবুল আক্তারই সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছিলেন। কিলার গ্রুপের নেতা মুছার সঙ্গে বাবুল আক্তারের কথোপকথনের রেকর্ড থেকে তার জড়িত থাকার বিষয়টি জানা গেছে। যদিও মুছা কোথায় আছে তা এখনো জানা যায়নি। মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন মেয়ে হত্যার জন্য বাবুল আক্তারকে দায়ী করে আসছিলেন। বাবুল আক্তার জড়িত থাকলে মিতুর পরিবার তাকে আসামি করে ফের মামলা করতে পারে।
বাবুল রাজধানীর মগবাজারের আদ দ্বীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত।
দীর্ঘ তদন্তের পর মঙ্গলবার মিতু হত্যা মামলার বাদী বাবুলকে তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ডেকে নেয়। সকাল ১০টায় বাবুল চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকায় পিবিআই মেট্রো অঞ্চলের কার্যালয়ে হাজির হন। জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যায় পিবিআইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাবুলকে আটক দেখানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মঙ্গলবার বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রামের পিবিআই কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ৩ বছর ১১ মাস ধরে মামলাটির তদন্ত করেছিল চট্টগ্রামের নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত বছরের মে মাসে পিবিআইয়ের কাছে মামলাটির তদন্তভার হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা। এই কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু বাবুল আক্তার মামলার বাদী, তাই তাকে আটক করা হয়েছে। তাকে বুধবার আদালতে হাজির করে গ্রেফতারের আবেদন করা হবে।
গত এক বছর ধরে তদন্ত শেষে পিবিআই নিশ্চিত হয়েছে, এই হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে বাবুল আক্তার সরাসরি জড়িত। দাম্পত্য কলহ ও পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরে বাবুল আক্তার তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রামে পাঁচজন কিলারকে ভাড়া করেন তিনি। কিলার গ্রুপের নেতৃত্ব দেন মুছা। হত্যার পর ঢাকা থেকে বাবুল আক্তার মোবাইল ফোনে কিলার মুছার সঙ্গে কথা বলেন। মোবাইল ফোনের সেই কল রেকর্ড এখন পিবিআইয়ের হাতে। এসব ঘটনা তদন্তের পর গতকাল বাবুল আক্তারকে ডেকে পাঠায় পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো।
সাবেক এসপি বাবুল আক্তার নিজেই স্ত্রী মিতু হত্যা মামলার বাদী। তাই তাকে গ্রেফতার করতে আদালতের নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে। আবার মামলার বাদী নিজেই হত্যাকা-ে জড়িত থাকলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে নতুন মামলা করতে হয়। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, আজ বুধবার আগের মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশের প্রতিবেদনের পর মাহমুদার পরিবার বাবুল আক্তারকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করতে পারে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ১৭ মিনিটে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে করে তিন দুর্বৃত্ত মিতুকে ঘিরে ধরে প্রথমে গুলি করে। এরপর কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। ঐ সময় মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তার আগে তিনি চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন বাবুল আক্তার। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ হত্যার সঙ্গে সাতজনের সংশ্লিষ্টতা পায়। অজ্ঞাত আসামির তালিকায় তাদের নাম ঢুকানো হয়।
সেই কল রেকর্ড : ২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ৩৭ মিনিটে কিলার মুছার মোবাইল ফোনে কল যায় তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোন থেকে। মাত্র ২৭ সেকেন্ডের সেই কথোপকথনের রেকর্ডটিই এখন মিতু হত্যার প্রধান আলামত ও সাক্ষী। সালাম দিয়ে মুছা ফোনটি রিসিভ করতেই ওপার থেকে বাবুল আক্তার বলেন, ‘তুই কোপালি ক্যান?’ তিন-চার সেকেন্ড থেমে আবার বলেন, ‘বল তুই কোপালি ক্যান? তোরে কোপাতে কইছি?’ ওপার থেকে মুছার কথা, ‘না মানে।’ বাবুল আক্তার তখন ফোনটি কেটে দেন। এই ২৭ সেকেন্ড কলের কথোপকথনের রেকর্ড পেয়েই হত্যাকা-ের ১৯ দিন পর ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুলকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কিছুদিন পর বাবুল পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেন। মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহী ও তাবাসুম তাজনিন টাপুরকে নিয়ে ঢাকার বনশ্রীর ভূঁইয়াপাড়ার শ্বশুরবাড়িতে উঠেছিলেন। তবে কয়েক মাস পর আলাদা বাসা ভাড়া করে সন্তানদের নিয়ে চলে যান। বাবুল আক্তার পরে মগবাজারে একটি হাসপাতালের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।
বাবুল-মিতুর দাম্পত্য কলহ : বাবুলের পরকিয়া প্রেমের এসএমএস নিয়ে স্ত্রী মিতুর সঙ্গে দাম্পত্য কলহ ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায় হত্যার সাত মাস আগে। এর মাধ্যমে গায়েত্রী এম্মারসিং নামের এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের তথ্য জানতে পারে মিতু। এ নিয়ে স্বামী বাবুল আক্তারের সঙ্গে মিতুর প্রত্যহ বাক্বিতণ্ডা শুরু হয়।
মিতুর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে একদিন বাবুল আক্তার বিছানার ওপর মোবাইল ফোন রেখে বাথরুমে যান। এ সময় একটি এসএমএস আসে বাবুলের মোবাইলে। তখন মিতু এসএমএসটি চেক করে দেখতে পান একটি আপত্তিকর বার্তা। তখন মিতু মোবাইলটির সুইস বন্ধ করে বাসার স্টোর রুমে লুকিয়ে রাখেন। এরপর বাবুল আক্তার ফোন খোঁজাখুঁজি করলে মিতু ফোনের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। পরদিন বাবুল আক্তার বাসা থেকে বের হলে মিতু মোবাইলের সিম বের করে মোবাইলটি অন করেন। এরপর ঐ মোবাইল থেকে একে একে ২৯টি এসএমএস (খুদে বার্তা) পড়েন। পরে এ ব্যাপারটি মিতু প্রমাণ হিসেবে ছেলের ছবি আঁকার আর্ট পেপারে লিখে রাখেন। এদিকে মোবাইল না পেয়ে বাবুল আক্তার ট্রাকিং করে নিশ্চিত হন যে, তার মোবাইল ফোনটি বাসাতেই রয়েছে। এই মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছে। বিষয়টি নিয়ে পরদিন মিতু ফোন দেয় তার মায়ের কাছে।
কি ছিল সেসব ম্যাসেজে : মিতুর মায়ের দাবি করা একটি আর্ট পেপারে লেখা ২৯টি মেসেজের সবগুলোই ইংরেজিতে লেখা। ম্যাসেজগুলোতে গায়ত্রী ও বাবুলের মধ্যে গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একটি ম্যাসেজে লেখা হয়েছে, ‘মাই পোয়েট মাই লাভ কাম টু মি’, ‘লাভ ইউ মাই কিং উড হ্যাভ কিসড ইউ প্যাশোনেটলি, ইফ ইউ ওয়্যার হেয়ার নাউ’, ‘লাভ ইউ বেবি, গুড মর্নিং, কাম টু সিøপ টু মি’।
গায়ত্রী এম্মারসিং জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র বাংলাদেশে প্রতিরোধ শাখার একজন কর্মকর্তা হিসেবে কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তখন বাবুল আক্তার কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমানে গায়ত্রী এম্মারসিং সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় কর্মরত।