মেইজি মডেল বাস্তবায়নের শিক্ষা বাজেট চাই - দৈনিকশিক্ষা

মেইজি মডেল বাস্তবায়নের শিক্ষা বাজেট চাই

সিদ্দিকুর রহমান খান, আমাদের বার্তা |

শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের প্রসঙ্গ এলেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ শিক্ষাভাবনায় রত অনেকের মুখেই মেইজির পদক্ষেপ অনুসরণের কথা শোনা যায়। তো সেই মেইজি সাহেব সম্পর্কে দুটি কথা দিয়েই লেখাটা শুরু করি। জাপানে ১৮৬৮ থেকে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিলো সম্রাট মেইজির শাসন। আধুনিক জাপানের রূপকার হিসেবে সম্রাট মেইজি নন্দিত। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর আগে জাপান অর্থনীতি, প্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রভূত উন্নতি সাধন করে। আড়াইশ বছরের সামন্ততান্ত্রিক যুগের অবসান ঘটিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্র ও বিশ্বশক্তি হিসেবে জাপানের উন্মেষ ঘটে। যদিও মেইজির উন্নয়নভাবনা যতো সহজে গ্রহণ করা যাবে, তাঁর অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি ততোটা না। রাজধানী টোকিও বিনির্মাণসহ বহু মেগা প্রকল্পের রূপকার সম্রাট মেইজি চীন ও রাশিয়াকে যুদ্ধে হারিয়েছেন। কোরিয়াকে করতলগত করে জাপানকে উন্নীত করেছেন গ্রেট পাওয়ারে। যদিও আমাদের প্রিয় রবী কবি জাপানিদের শিক্ষাচেতনায় ঘাটতি দেখতে পেয়েছিলেন।

মেইজির মৃত্যুর মাত্র চার বছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল জাপানিরা। কবিগুরু মেইজি শাসনের উগ্র জাতীয়তাবাদ উন্মাদনা একদম মেনে নিতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এক বন্ধুকে লিখেছিলেন:   ‘হিরের দামে ঠুনকো কাঁচ কিনতে আমি নারাজ। জীবদ্দশায় মানবতার ওপর দেশপ্রেমকে তাই ঠাঁই দিতে চাই না।’ সেই কাঁচ আর হিরের ফারাক শেখাতে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আদৌ ভূমিকা রাখছে কী। 

২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল-খ্যাত আ হ ম মুস্তফা কামাল শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে বাংলাদেশেও জাপান সম্রাট মেইজির বিদেশি শিক্ষক নীতি অনুসরণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, জাপান সম্রাটের পথ অনুসরণ করার সময় আমাদের এসে গেছে এবং প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসতে এই বাজেটেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

তিনি আরো বলেছিলেন, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীর ঘাটতি নেই, ঘাটতি দেখা দিয়েছে উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের। প্রাথমিক থেকে শুরু করে শিক্ষার সব স্তরে উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের কাছে আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে হস্তান্তর করতে চাই। আর সেই উপযুক্ত শিক্ষক বাছাই করে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকার এই বছর থেকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।

তিনি আরো বলেছিলেন, আমাদের শ্রেণিকক্ষে ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লকচেইন টেকনোলজির মতো সময়োপযোগী সব বিষয় শেখাতে হবে।

পাঠক, এবার মেইজি বিষয়ক আলোচনা শুরুর আগে আমাদের লোটাসের ওপর আলো ফেলি। ছোটবেলা থেকে গল্প শুনেছি লোটাস কামালের মেধা ও পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের। তাই পত্র-পত্রিকায় ওইসব পড়ে তার প্রতি একটা শ্রদ্ধা ও আগ্রহ ছিলো বরাবরই। অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর খুব খুশী হয়েছিলাম এই ভেবে যে, এবার বরাদ্দে শিক্ষাখাত কিছুটা হলেও অগ্রাধিকার পাবে। শিক্ষক তথা শিক্ষার উন্নয়ন ভাবনায় শিক্ষামন্ত্রীকে আর টাকার জন্য হাপিত্যেশ করতে হবে না। ভালো কিছুর জন্য বাজেট বরাদ্দ চাইলেই পাওয়া যাবে। 

গত দুই যুগে সচিবালয়ে যাতায়াতে যেটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে দেখেছি, অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী এক কোরামের না হলে বা পাণ্ডিত্যে সমমানের না হলে বা বিশেষ সখ্য না থাকলে শিক্ষাখাত বরাদ্দের দিক থেকে কিছুটা হলেও বঞ্চিত হয়। এই সময়ে আমার আরেকটি অভিজ্ঞতা হলো : তুলনামূলক স্থিত ধী ও চৌকস ক্যাডার কর্মকর্তারাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের পদগুলোতে থাকেন। শিক্ষাসচিবদের দেখেছি অর্থ সচিবের কাছে আবেদন-নিবেদন নিয়ে যাওয়ার আগে প্রশ্ন, সম্পূরক প্রশ্ন ও উত্তর রেডি করে নিয়ে যেতে।

লোটাস মানে পদ্মফুল। আমাদের লোটাস কামাল সাহেব ভালে শিক্ষক নিয়োগের কথা বলেছিলেন। শিক্ষক আমদানির কথা বলেছিলেন। তাঁর পাঁচ বছর অর্থমন্ত্রিত্বকালে তার তরফে দেশে শিক্ষক নিয়োগ তথা শিক্ষাখাতে চোখে পড়ার মতো কোনো বরাদ্দ দেখিনি। শুধু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয় ছাড়া।

আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। একজন শিক্ষামন্ত্রী মাত্র কয়েক কোটি টাকার জন্য একটা জনপ্রিয় বিষয় বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। একেবারে একান্তে আলোচনায় তাকে বলে বসলাম- ভাই, একটু আপনার এলাকার বড়ভাই অর্থমন্ত্রীর কাছে গেলেই তো হয়। তাকে উদাহরণ হিসেবে আগের সরকারের একজন অর্থমন্ত্রীর কাছে গিয়ে কিছুটা কৌশল ও কিছুটা বুদ্ধি খাটিয়ে একজন শিক্ষামন্ত্রীকে একটা খাতের জন্য অর্থ বরাদ্দ আনতে দেখেছিলাম। সেই অর্থমন্ত্রী সাফ বলে দিয়েছিলেন, ওই খাতে আর বরাদ্দ হবে না। তবুও সেই শিক্ষামন্ত্রী কিছু টাকা আনতে পেরেছিলেন। অনেকটা পরিবারের রাগী-ত্যাগী-মেধাবী বড়ভাইয়ের কাছ থেকে যুক্তিতর্ক করে টাকা খসানোর মতো ঘটনা। তো সেই পরামর্শের জবাবে সেই শিক্ষামন্ত্রী আমাকে বললেন- বলেন কি …ভাই তো শিক্ষা জীবনে কখনো সেকেন্ড হননি। তার খাতাও দেখতেন না সব সারেরা। কারণ, তার খাতায় কোনো ভুল থাকতো না। অল থ্রু ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তিনি তো আগুন। আমরা ছাত্রজীবনেই তার ধারেকাছে যেতাম না, এখন আবার! শিক্ষামন্ত্রীর এমন মন্তব্যে আমারও মন্ত্রীতে মন্ত্রীতে শ্রেণি বিভাজনের অজানা বিষয় জানা হলো। 

এটা সত্যি যে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বায়নের যুগে সুশিক্ষা এবং জ্ঞানে-বিজ্ঞানে মানসম্পন্ন জাতি হওয়ার বিকল্প নেই। আমরা দেখলাম, হঠাৎই মেইজির কথা আনলেন, আবার লোটাস কামাল সাহেব নিজেই হারিয়ে গেলেন। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রেখে গেলেন ‘সাবেক হুকুম বহাল’ তন্ত্র।  

আমরা এবারে নতুন অর্থমন্ত্রী পেয়েছি, যিনি একজন সাবেক পেশাদার কূটনীতিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রভাষক। এছাড়া আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাহেব অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন গত পাঁচ বছর। সুতরাং অর্থের নাড়িনক্ষত্র সব জানা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর অদ্যাবধি তিনি শিক্ষাখাত বা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে গভীর অথবা অগভীর কিছুই বলেছেন বলে নজরে আসেনি।

নতুন অর্থ বছরের বাজেট আসছে। সাংবাদিক পদে কতিপয় চাকরিজীবীর কল্যাণে  শিক্ষাবিদের তকমা পাওয়া শিক্ষা বিষয়ক এনজিওর মালিকরা দামী হোটেলে সংবাদ সম্মেলন ডেকে শিক্ষা বাজেট নিয়ে পুরনো কথা নতুন মোড়কে উপস্থাপন করবেন। মঞ্চে উপবিষ্ট রাখবেন দুলাভাই অর্থনীতিবিদ! আর চোখ ধাঁধানো লাইটের আলো ও চাকচিক্যে সাংবাদিকরা এনজিও মালিকদের এই প্রশ্ন করতে ভুলে যাবেন যে, আপনাদের এনজিওর মোর্চা থেকে গত ২৫ বছরে দেশের শিক্ষার উন্নয়নে মোট কত কোটি ডলার এনেছেন এবং শিক্ষার কি কি উন্নতি ঘটিয়েছেন। এছাড়া দেশ বিদেশে আপনাদের মোট কতটি বাড়ী-গাড়ী আছে? 

আমরা আরো দেখতে পাবো, কিছু শিক্ষক সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন আর মানববন্ধন, যেখান থেকে দাবি করা হবে শিক্ষাখাতে ৬/৪ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ চাই। 

শেষ কথার আগের কথা বলি। নওফেল নামের অর্থ খুঁজতে গুগলে সার্চ দেই। এই নামের মানুষেরা কেমন হয়। অনেক অর্থ ও স্বভাবের মধ্যে দুটি উল্লেখ করি। এক. সুদর্শন ও উদার নৈতিক পুরুষ। দুই. বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে ছেড়ে না গিয়ে তাদেরকে আদরযত্নকারী। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক শিক্ষক অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী আর উদারনৈতিক শিক্ষামন্ত্রী যুগপৎ চেষ্টায় শিক্ষাখাতে বেশি বরাদ্দ রেখে বাংলাদেশে মেইজি যুগের সূচনা করবেন বলে গভীর প্রত্যাশা করি।  

 

তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কমিটি - dainik shiksha তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কমিটি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্তির দাবি - dainik shiksha স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্তির দাবি ঢাবিতে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি নির্দেশিকা প্রকাশ - dainik shiksha ঢাবিতে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি নির্দেশিকা প্রকাশ শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজকে ভাসানী নামকরণের দাবি - dainik shiksha শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজকে ভাসানী নামকরণের দাবি এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচির সমন্বয় সভা কাল - dainik shiksha এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচির সমন্বয় সভা কাল ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২২ ডিসেম্বর - dainik shiksha ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২২ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034968852996826