মেধাবীদের কষ্টের নাম ‘মাত্রাতিরিক্ত কোটা’ - দৈনিকশিক্ষা

মেধাবীদের কষ্টের নাম ‘মাত্রাতিরিক্ত কোটা’

সাধন সরকার |

সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা বণ্টন নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ চরমে পৌঁছেছে। সম্প্রতি হাইকোর্টের এক আংশিক রায়ে ‘মাত্রাতিরিক্ত কোটা’ ব্যবস্থা আবার বহাল থাকার বিষয়কে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন ফুঁসে উঠেছে। স্বাধীনতার পর নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা চালু হয়। সময়ে সময়ে কোটার পরিমাণ কমেছে কিংবা বেড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কোটার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বরাবরই ছিলো। কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে। তখন কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন করে কোটা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা (পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের যুক্ত করা হয়), ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ জাতিগোষ্ঠী ও ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত ও বিভিন্ন করপোরেশনের সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (১ম ও ২য় শ্রেণি) কোটা ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে। সরকারের সেই প্রজ্ঞাপন বা পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সম্প্রতি কোটা ব্যবস্থা বহালের ইঙ্গিত দেয়। যদিও বিষয়টি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন ছিলো মূলত সরকারের কাছে। তখন সাধারণ ছাত্ররা ‘মাত্রাতিরিক্ত’ কোটার সংস্কার চেয়েছিলো। কিন্তু সরকার সংস্কার না করে পুরোপুরি বাতিল করে দেয়। তখন যদি সব পক্ষ মিলে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার করা হতো তাহলে বিষয়টি নিয়ে এত জলঘোলা হতো না। সবমিলিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার দখলে। বাকি ৪৪ শতাংশ মেধা কোটা। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন কোটা বিন্যাস নেই। উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স সাধারণ শিক্ষার্থী চাকরিপ্রত্যাশীদের চেয়ে দুই বছর (৩২ বছর পর্যন্ত) বেশি পেয়ে থাকে। এক কথায় বলতে হয়, সরকারি চাকরিতে প্রকৃত মোধাবীদের থেকে কোটাধারীদের সুযোগ বেশি। এই ৪৪ শতাংশের মেধা কোটার মধ্যে আবার রয়েছে প্রশ্ন ফাঁস ও তদবির বাণিজ্যের মতো নানা অভিযোগের ঘটনা। 

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ এর ৩ (ক) উপধারায় বলা হয়েছে- ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ বিভিন্ন সময় বিশেষজ্ঞরাও অভিমত দিয়েছেন-কোটার প্রয়োজনও রয়েছে, তবে সেটা ১০ শতাংশের বেশি নয়। মাত্রাতিরিক্ত কোটার কারণে মেধাবীরা তাদের যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যুগের পর যুগ সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের হক নষ্ট করে তুলনামূলক কম মেধাবী কথা কোটাধারীদের সুযোগ দানের ফলে সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে এখন সেটার বিষ্ফোরণ দেখা যাচ্ছে।  

দেশের বীর সন্তান তথা মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছিলেন বৈষম্যহীন, ক্ষুধামুক্ত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিলো সবার ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তাদের প্রতিবাদ ছিলো সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বড় কথা মুক্তিযোদ্ধারা কোটার জন্য যুদ্ধ করেননি। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও কেনো কোটা নামক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের মাঠে নামতে হবে? মুক্তিযোদ্ধাদের পরিপূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে রাষ্ট্র। অর্থনৈতিক সুবিধাসহ তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে এবং আগামীতে আরো বাড়বে। তারা সর্বদা ভালো থাকুক-এটাই সবারই চাওয়া। কিন্তু কোটার গ্যাঁড়াকলে পড়ে মেধাবীরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য অধিকারটুকু পাবেন না-এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বেমানান। 

অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় মেধাবীরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। তাই মেধা বাঁচাতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কার সময়ের দাবি। মুক্তিযোদ্ধাদের ‘নাতি-নাতনি কোটা’ ব্যবস্থা নিয়ে শুধু সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে নয়, জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তুষ্টি রয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের অনন্তকাল কোটাসুবিধা পাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। কোটা রাখার যৌক্তিকতা বা গুরুত্ব হয়তো একটা সময় ছিলো। কিন্তু এখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে অনগ্রসর বলার সুযোগ নেই বললেই চলে। সেই বিবেচনায় কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন অবশ্যই যৌক্তিক। এই একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে মেধার থেকে কোটাকে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, কোটাধারীরা ছাড়া খুব কম লোকই কোটা ব্যবস্থার পক্ষে। বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে, বিসিএসের চাকরিতে ৫৬ শতাংশ, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির অন্যান্য চাকরিতে (নন-ক্যাডার) ৬১ শতাংশ, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন চাকরিতে ৭০ শতাংশ, রেলওয়ের চাকরিতে ৮২ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ৯৬ শতাংশ কোটা রয়েছে। এতো এতো কোটার ভিড়ে প্রকৃত মেধাবীরা সত্যিই অসহায়। 

সাধারণ ছাত্রদের এই কোটাবিরোধী চলমান যৌক্তিক আন্দোলনে সরকারকে অবশ্যই গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনি কোটাসহ বিভিন্ন কোটার হার এতো বেশি পরিমাণ রাখার প্রয়োজন রয়েছে কি না- সেটা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। সরকারের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারাও ‘মাত্রাতিরিক্ত কোটা’ সংস্কারে এগিয়ে আসতে পারে। দেশের স্বার্থে মেধাবীদের স্থান দিতে হবে সবার আগে। তবে প্রতিবন্ধী কোটাসহ সবমিলিয়ে ১০ শতাংশের বেশি কোটা রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আজ কিংবা কাল ‘মাত্রাতিরিক্ত কোটা’ ব্যবস্থার যৌক্তিক পর্যায়ে সংস্কার করতেই হবে। কেনোনা এটা সময়ের চাহিদা। কোটা নামক বৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের জয় হোক-এটাই কাম্য।

লেখক: শিক্ষক

বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বোর্ডে বিক্ষোভ - dainik shiksha বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বোর্ডে বিক্ষোভ পাসের দাবিতে ফেল করা শিক্ষার্থীদের পাঁচ শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও - dainik shiksha পাসের দাবিতে ফেল করা শিক্ষার্থীদের পাঁচ শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও ছাত্র হত্যা : কর্মচারীদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ নেয়া সেই অধ্যক্ষ গ্রেফতার - dainik shiksha ছাত্র হত্যা : কর্মচারীদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ নেয়া সেই অধ্যক্ষ গ্রেফতার চবিতে শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের সং*ঘর্ষ - dainik shiksha চবিতে শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের সং*ঘর্ষ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পবিপ্রবিতে কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুক্রবার, শেষ হয়েছে সব প্রস্তুতি - dainik shiksha পবিপ্রবিতে কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুক্রবার, শেষ হয়েছে সব প্রস্তুতি প্রাথমিকে উপবৃত্তি বন্ধের তথ্য সঠিক নয়: অধিদপ্তর - dainik shiksha প্রাথমিকে উপবৃত্তি বন্ধের তথ্য সঠিক নয়: অধিদপ্তর please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029971599578857