দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতক প্রথমবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখা ও তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সম্মুখ সমরের প্রধান যোদ্ধা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী এবং তাদের পেছনে অভিভাবকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারক এবং শিক্ষকদের পক্ষ কোনটি তা স্পষ্ট নয়। এ যুগের অসহায় অভিভাবক আর উচ্চশিক্ষাপ্রত্যাশীদের বড় অংশ এ অবস্থার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই দায়ী করেন। মঙ্গলবার (১ মার্চ) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, সাধারণ অভিভাবক আর শিক্ষার্থী যতই করুণ দশায় নিপতিত হোক না কেন, অনেকের মতে আমরা শিক্ষকরা কল্পতরু আর সুবিধার বৃক্ষ থেকে নিচে নামতে চাই না। অনেক শিক্ষক আবার মনে করেন, প্রতিটি পরীক্ষার্থীর নাড়ি টিপে টিপে যোগ্যজনকে খুঁজে বের করবেন।
ভর্তি পরীক্ষার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের পরিচিত লাইনটি বারবার মনে পড়ে। ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী।’ যেখানে আমাদের ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের ধারণ করতে হলে মাঝ সমুদ্রে নোঙর করা মাদার শিপের দরকার, সেখানে আমাদের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণক্ষমতা এক করলেও একটি ছোট ফিডার জাহাজ হবে না। এখন মেধা নয়-লটারির মতো হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টিকিট পাওয়া।
এমন বাস্তবতার পরও অন্য পক্ষের যুক্তি হচ্ছে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। শিক্ষকরা তাদের প্রয়োজন অনুসারে মেধাবী শিক্ষার্থী বেছে নেবেন। গুচ্ছভর্তি পরীক্ষায় সেই সুযোগ থাকবে না। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের কারও কারও যুক্তি আছে। ভর্তিযুদ্ধের নানা ক্ষতিকর দিক থাকলেও তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে নিজ পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় সে সুযোগ থাকবে না। পঞ্চগড়ের একজন বাবা তার মেয়েকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে মোটেও রাজি হবেন না।
সবকিছুর পরও বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে করোনাকালের মহাঝাঁকির পর এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকরা গুচ্ছ পরীক্ষার ছায়াতলে এসে জড়ো হচ্ছেন। অনেকে আবার নানা যুক্তিতে একলা চলো নীতিতেই রয়েছেন।
ভর্তি পরীক্ষার সময় বেশকিছু অমানবিক দৃশ্য দেখতে হয় আমাদের। সকাল ৯টায় শুরু হয়ে নানা শিফটের পরীক্ষা, শেষ হয় সন্ধ্যায়। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকে ভরে যায় জাহাঙ্গীরনগরের বিশাল ক্যাম্পাস। এ সময়ের পরিচিত অমানবিক ছবিগুলো এমন-ভোরে বাবা মেয়েকে নিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে নাইট কোচে নেমেছেন। হাতে ব্যাগ। উদভ্রান্ত চেহারা। নির্ঘুম রাত কেটেছে। মুখ ধোয়া, ফ্রেস হওয়া ইত্যাদি নানা প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার পরীক্ষার্থী ছুটছে স্রোতের মতো। সে তুলনায় আসন সংখ্যা অতি সীমিত; ভর্তির সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি একেবারে লটারির মতোই।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকগুণ বেশি ভর্তির সুযোগ রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোতে। সেখানেও প্রতিযোগিতা খুব কম নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এত ছুটোছুটি করতে হয় না সেখানে। কিন্তু বাস্তবতা বুঝতে না পেরে ভর্তিযুদ্ধে নামা অনেক শিক্ষার্থী ভুল করে দুকূলই হারায়। স্বাভাবিকভাবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আশা করে এবং স্বপ্ন দেখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বে।
তাই অবহেলা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজ থেকে ফরম তোলে না। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে সেই সময়ও উতরে যায়। তাই শেষ পর্যন্ত দুকূল হারিয়ে হতাশায় নিপতিত হতে হয়। তখন দরোজা অবারিত থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখানে অভিভাবকদের সাধ্যের প্রশ্ন রয়েছে। যাদের অগাধ সাধ্য তারা প্রথম শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে না হয় ভর্তি হতে পারে। কম সাধ্যের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের মাঝারি ও নিম্ন-মাঝারি মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করাতে বাধ্য হন। দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তারপরও কি সবাই ঠাঁই পায়? অনেকেই হতাশ হয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়ে।
ভর্তি পরীক্ষায় ফরম তোলার যোগ্যতা যাদের আছে, আমি বিশ্বাস করি তাদের যে কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দিলে সে সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করতে পারবে। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নাড়িনক্ষত্র জেনে ভর্তি করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এর ভেতর বাস্তব চিন্তা যতটা না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে অমানবিক বাণিজ্যচিন্তা। এখন শিক্ষার নীতিনির্ধারণে যেন সবাই রাজা। তাই ইচ্ছামতো পালটে যাচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতি। কিছুদিন আগেও প্রতিযোগিতা দিয়ে জিপিএ-পাঁচ আর স্বর্ণখচিত পাঁচের সংখ্যা বাড়ানো হতো। শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করে ফেলা হয়েছে কোচিং আর গাইডবইয়ে।
বেশ কয়েক বছর আগে যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অলিখিত আদেশে শিক্ষকদের ঝাঁপি ভরে নম্বর দিতে হতো, সে সময় আমার এক সরকারি আমলা বন্ধু যখন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা এত কম পাশ করাও কেন? দেখলাম সেই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা তিন চার ভাগ শিক্ষার্থী পাশ করেছে।’ আমি তাকে পালটা বললাম, এর চেয়ে বেশি পাশ করলে আমি বিস্মিত হতাম। বন্ধু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ব্যাখ্যা করলাম-এখন জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় পরীক্ষায় বস্তা বোঝাই নম্বর পাওয়ার পদ্ধতি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
এটি এমনই এক পদ্ধতি যে, এর জন্য কোনো শিক্ষার্থীকে আর গোটা বই পড়তে হয় না। গাইড, নোট এবং মডেল টেস্টের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর স্বর্ণউদ্যানে পৌঁছা সম্ভব। এসব কারণে বহু শিক্ষার্থী চারপাশের জ্ঞানের জগৎ সম্পর্কে ভালোভাবে জানার দরকার মনে করছে না। এ ধরনের শিক্ষার্থীরাই সমস্যায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় এসে। কারণ ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন করার সময় চেষ্টা করা হয় এইচএসসি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর যা যা পড়ে আসার কথা, চারপাশের জীবন-জগৎ সম্পর্কে যেটুকু খোঁজখবর রাখার কথা, তা তারা রেখেছে কিনা তা যাচাই করে নেওয় হয়।
পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে চকচকে গ্রেডের নেশায় আমাদের মেধাবী সন্তানরা ওদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছে না। ফলে শতকরা চার পাঁচ ভাগের বেশি শিক্ষার্থীর পক্ষে এই বৈতরণী পাড়ি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণেই বলি যে, স্কুল থেকে প্রচলিত শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই শিক্ষার্থীদের এক ধরনের বিকলাঙ্গ বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এমন বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতেগোনা কয়েকটি আসনের বিপরীতে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ছুটে বেড়ানোর অসহায় শাস্তি থেকে উদ্ধারের জন্য গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। তবে একে বাস্তবায়ন করাটা অত সহজ নয়। এ বিশাল কর্মযজ্ঞকে কার্যকর করতে হলে অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। অবশ্য কী কী পদ্ধতিতে গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা কার্যকর করা হবে, সে ব্যাপারে আমাদের অনেকের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। সাধারণ্যে এসব ধারণা আরও স্পষ্ট করতে হবে।
আমি মনে করি না দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে চলমান প্রক্রিয়ায় যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় তারা নিজেদের পছন্দের বিভাগে ভর্তি হতে পারে। পাশ করার সুবাদে কখনো যেমন করে ভাবেনি, তেমন বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী।
এটিই বাস্তবতা। আর যেসব সম্মানিত সহকর্মী ভাবেন আমরা বেছে বেছে মেধাবী প্রার্থীদের ভর্তি করব, তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। শিক্ষার্থীকে তৈরি করার দায়িত্ব শিক্ষকের-বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমি বিশ্বাস করি, ভর্তির জন্য আবেদন করার যে ন্যূনতম যোগ্যতা ধরা হয়, সেই যোগ্যতার শেষ প্রান্তের শিক্ষার্থীকেও যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়, তবে ঠিকমতো পরিচর্যা করলে সেও উজ্জ্বল ফলাফল করতে পারবে।
গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষা নেওয়ার বিরোধিতা করার পেছনে অনেকে শিক্ষক বাণিজ্যবুদ্ধির কথা বলেন। এ অভিযোগ অনেকাংশে যে সত্য নয়, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত সত্যকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারি আমলাদের একটি বড় আর্থিক বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে অনেক আগে। বেতন কাঠামোর বিচারে শিক্ষকরা যে খারাপ আছেন তা বলা যাবে না। এই ভালোটি কিন্তু দুবেলা ভালো খেয়েপরে চলার মতো। শতকরা দু-চার ভাগ শিক্ষক যারা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন পড়ানোর সুযোগ পান বা বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করেন, তাদের বাদে বৃহত্তর সংখ্যক শিক্ষকের অবস্থা যে খুব ভালো তা নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং করানো নিষিদ্ধই বলা যায়। নানা ধরনের কর্তনের পর পাওয়া বেতনের সীমিত অর্থেই সংসারের নানা চাহিদা মেটাতে হয়। একজন সিনিয়র অধ্যাপক যিনি রাষ্ট্রের এক নম্বর গ্রেডে বেতন পান, তার আর্থিক সুবিধাও একজন ডেপুটি সেক্রেটারির চেয়ে কম। একজন শিক্ষক যখন দেখেন সারাজীবন শিক্ষকতা করে একটি গাড়ি কেনার সাধ্য হলো না, বিশ্ববিদ্যালয়েরও সাধ্য নেই; কমন বাসেই যাওয়া-আসা করতে হয়। আর পাশাপাশি দেখেন তার ডিএস ছাত্র স্বল্প সুদে গাড়ি কেনার টাকা পাচ্ছেন। ড্রাইভারের বেতন আর গাড়ি পরিচর্যার জন্য মাসে পাচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা।
এ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো শিক্ষক হতাশ হতেই পারেন। এ প্রবীণ শিক্ষক দেখেন বাড়িভাড়া ও অন্য সব কর্তন, ব্যাংক লোন, প্রভিডেন্ড ফান্ডের লোন নেওয়ায় কাটাকাটির পর বেতন হিসাবে যা হাতে পান, তা তার ডিএস ছাত্রের গাড়ি মেইনটেন করার ভাতার চেয়েও তা কম, তখন একটু হতাশা তাকে গ্রাস করতেই পারে। এই যদি হয় সিনিয়র শিক্ষকের অবস্থা, তাহলে জুনিয়রদের অবস্থা কেমন তা সহজেই অনুমান করা যায়। এমন বাস্তবতায় একজন শিক্ষক যদি চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন ভর্তি পরীক্ষার দিকে আর বাজেট তৈরি করেন এবার ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষ্যে আসা অর্থের বিনিময়ে সংসারের প্রয়োজনীয় ফ্রিজটি কিনবেন বা ডাইনিং টেবিল বানাবেন তাহলে তা কতটা অন্যায় হবে?
তবুও বৃহত্তর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে শিক্ষকদের অধিকাংশ গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে মত দেবেন বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অমানুষিক কষ্ট লাঘব করতে চাই। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষকই এক্ষেত্রে আর্থিক লাভ প্রত্যাশা করেন না। এ অবস্থায় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।
লেখক : ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়