দোরগোড়ায় চলে এসেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মাসখানেক পরই শুরু হবে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এই মহাসম্মিলন। নতুন নতুন বইয়ের সঙ্গে দর্শনার্থী-ক্রেতা-কবি-লেখকদের ভরপুর আড্ডায় জমে উঠবে মাসব্যাপী এই মহা আয়োজন। বইমেলা সামনে রেখে প্রস্তুতিও চলছে সমানতালে। প্রকাশক থেকে শুরু করে মুদ্রণ, বাঁধাই ও পরিবহনসহ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। রোববার (২২ ডিসেম্বর ) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফা বুলবুল।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ছাপাখানা ও বাঁধাইখানাগুলোয় এই ব্যস্ততা গত ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। বইমেলার ক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে, ব্যস্ততা তত বেড়ে চলেছে। ছাপাখানার মালিকরা বলেছেন, কাজের চাপ এত বেশি যে মধ্য রাত পর্যন্ত প্রেস চালু রাখতে হচ্ছে। মেলা চলাকালীনও তাদের এই ব্যস্ততা থাকবে বলে জানা গেছে।
বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, নীলক্ষেত, কাঁটাবনের ছাপাখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, নতুন বই ছাপাতে মানুষের ব্যাপক ব্যস্ততা। কথা বলার সময় নেই কারও। ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত বই ছাপার কাজ চলছে। এ যেন পাঠকের হাতে বই তুলে দেয়ার অন্যরকম এক মহা উৎসব। যে উৎসবের সঙ্গে জড়িত অনেকেই।
সাধারণত কাঁটাবন এলাকা মঙ্গলবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। আসন্ন মেলা উপলক্ষে প্রকাশকরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনও মার্কেট খোলা রেখেছেন। পুরান ঢাকার প্যারীদাস রোডে ঢুঁ দিতেই দেখা গেল, ভ্যানে করে কাগজের স্ত‚প টানা হচ্ছে। সেখানে শোনা গেল, ছাপাখানার খস খস ঘস ঘস শব্দ। ছাপাখানাগুলোর ভেতরে বাইরে গাদা গাদা কাগজ। একটি ছাপাখানায় ঢুকতেই রঙের ঝাঁজালো গন্ধ নাকে এসে লাগল। ছাপার যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছে সদ্য ছাপা হওয়া কাগজের বড় শিট।
এরপর এগুলোকে বাঁধাইখানায় নেয়া হচ্ছে। কেটে বাঁধাইয়ের পর নতুন বইগুলো প্রকাশনা সংস্থার দোকান ও গুদামে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। কাঁটাবন মোড়ের প্রিন্ট গ্যালাক্সির সামনের অংশ দেখে বোঝার উপায় নেই এর ভেতরে এত কর্মযজ্ঞ চলছে। প্রতিষ্ঠানটি এবারের বইমেলা উপলক্ষে ১০টির বেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ছাপার কাজ করছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ৩টি বাই কালার ছাপার যন্ত্রে ১০ জন শ্রমিক কাজ করছেন।
প্রিন্ট গ্যালাক্সির স্বত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিনই বই ছাপার নতুন অর্ডার আসছে। কাজের চাপ এত বেশি যে নভেম্বর থেকে ২৪ ঘণ্টা প্রেস চালু রেখেছি। শ্রমিকরা মধ্য রাত পর্যন্ত কাজ করছেন।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি জানায়, বাংলাবাজার থেকে শুরু করে সূত্রাপুর, গোপীবাগ, ফকিরাপুল, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, নীলক্ষেত ও কাঁটাবনে বইমেলার কাজ চলছে। এ এলাকাগুলোয় প্রেসের সংখ্যা প্রায় ২ হাজারের মতো। প্রকাশকরা অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই বই ছাপার কাজ শুরু করেন। তবে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান এবং মেলার আগে নতুন নতুন লেখকদের কারণে শেষের দিকে ছাপাখানাগুলোয় চাপ বেশি থাকে।
অন্যদিকে বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রেসপাড়ায় ব্যস্ততার পাশাপাশি ব্যস্ত সময় পার করছেন কবি-লেখক-প্রচ্ছদশিল্পীরাও। লেখক ও প্রচ্ছদশিল্পীদের কেউ পরিবর্তন, পরিমার্জন কেউ বা এখনো নিমগ্ন নতুন সৃষ্টিকে সবার সামনে তুলে ধরতে। প্রতিবছরের মতো প্রত্যাশা, এবারের বইমেলাও মুখর থাকবে দর্শকক্রেতা-পাঠকের পদচারণায়।
শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর জানান, ইতোমধ্যে শতাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন তিনি। আরো অনেক বইয়ের কাজ বাকি রয়েছে। এসব কাজ সমাপ্ত করতে হবে মেলার আগেই।
এবার অর্ধডজন নতুন বই নিয়ে মেলায় অংশ নেবেন স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রিদম। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী গফুর হোসেইন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিতব্য বইগুলোর ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়ে হয়েছে। মূলত মেলা ফেব্রুয়ারিজুড়ে এক মাস হলেও আমাদের কর্মকাণ্ড চলে সারা বছরই। এবারের মেলার শুরুতেই রিদম থেকে ৭০ ভাগ বই স্টলে নিয়ে যেতে পারব বলে আশা করছি। এ বছর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১০টির অধিক গ্রন্থ প্রকাশ করবেন বলে জানালেন এই প্রকাশক নেতা।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেহুলাবাংলার স্বত্বাধিকারী তরুণ প্রকাশক কবি চন্দন চৌধুরী বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিতব্য বইগুলোর ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এবার শতাধিক নতুন বই নিয়ে মেলায় অংশ নেব আমরা।
বাংলা একাডেমির প্রস্তুতি : এদিকে বইমেলা আয়োজনে প্রস্তুতি চলছে বাংলা একাডেমিতেও। এরই মধ্যে বৈঠক হয়েছে দফায় দফায়। চলছে সফলভাবে বইমেলা আয়োজনের নানা কর্মযজ্ঞ। তবে এবার মেলায় প্রবেশে বাগড়া দিতে পারে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বরের দিকে মেট্রোরেলের জন্য এরই মধ্যে সড়কের মাঝখানে কাজ চলছে। বেড়া দিয়ে কাজ করার ফলে সরু হয়ে এসেছে রাস্তা। তাছাড়া খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ধূলি-ধূসরিত ওই এলাকা।
বইমেলার প্রস্তুতি প্রসঙ্গে কথা হলো মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব, গবেষক ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমি অমর একুশে গ্রন্থমেলার কাজ শুরু করেছে চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে। মেলার স্টলের আবেদনপত্র নেয়া হয়েছে, মূল্যায়ন হয়েছে, এবার স্টল বানানো হবে। আওয়ামী লীগের সম্মেলনের কারণে স্টল বানানোর কাজ পিছিয়ে ছিল। তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে স্টলের কাজ শুরু হবে।
মেট্রোরেলের কারণে প্রবেশ পথ নিয়ে মেলাকে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেট্রোরেলের কারণে হয়ত কিছুটা সমস্যা হবে। তবে মেলার প্রবেশপথ আরো বাড়বে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে, তারা বলেছে টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রাস্তাটা পরিষ্কার করবে। তবে মেট্রোরেলের পিলারগুলো থাকবে। অন্যান্য বছরের তুলনায় মেলার পরিসর এবছর আরো বাড়বে বলেও জানান ড. জালাল আহমেদ।