মেহিকো : গাছের দেশ রঙিন বেশ - দৈনিকশিক্ষা

মেহিকো : গাছের দেশ রঙিন বেশ

আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল |

সম্প্রতি উত্তর গোলার্ধের একটি দেশে দীর্ঘ এক মাস কাটিয়ে এসে কি কি দেখলাম তার তালিকা করতে বসে দেখি, না দেখার তালিকাই দীর্ঘ। দীর্ঘ এক মাসে ৭/৮টি শহর ঘোরার সুযোগ হয়েছে, তবুও যেন তৃপ্তি নেই। একটা দেশ কত যে রঙিন হতে পারে, সবুজ হতে পারে তা মেহিকো না এলে বুঝতে পারতাম না। 

আপনারা ভাবছেন, মেহিকো  আবার কোন দেশ? ইংরেজিতে যাকে আমরা মেক্সিকো (Mexico) বলি, তার স্প্যানিশ নাম হচ্ছে “মেহিকো”। আমার দেখা অন্যতম সুন্দর দেশ। কি নেই দেশটিতে, হাজার বছরের টোলটেক, অ্যাজটেক, মায়া সভ্যতার ইতিহাস, পিরামিডের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। আর খাবারের কথাই বা কেন বাদ পড়বে? পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল মরিচ এই দেশেই পাওয়া যায়। বাঙালির মতন তারাও ঝালপ্রিয় জাতি।

কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে তাদের গাছ প্রেম দেখে। কি শহর, কি গ্রাম সর্বত্রই গাছের অপার সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার লেখায় তাই মেক্সিকোর গাছপ্রেম বারবার আসবে। ইট পাথরের যান্ত্রিক শহরকেও যে কিভাবে প্রকৃতির জোয়ারে বদলে দেয়া যায় তা মেহিকো না এলে বুঝা যেত না । আহ? কী অসীম মায়া প্রেম তাদের এই গাছের প্রতি। মেহিকো সিটিতে কেউ যদি একদিনের জন্যও যান, তবে পায়ে হেঁটে ঘুরে আসুন চাপুলতেক পার্ক এবং তার সামনে  Pase de la রিফর্মাতে।  শনিবার ও রোববার সবচেয়ে উত্তম দিন সেখানে ঘুরে আসার। হাজার হাজার মানুষ সেদিন সেখানে জড়ো হয়ে নানা উৎসবে মেতে থাকেন। সাইকেল নিয়ে, হেঁটে, কুকুরকে সঙ্গী করে, স্কেটিং, জগিং করে ব্যস্ত সময় পার করেন। রোববার শহরের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি চলাচল নিষেধ। সেদিন শুধু সেখানে পায়ে হাঁটা ও সাইকেল ওয়ালাদের দিন। শুধু তাই নয়, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের চেয়ে পুরাতন গাড়ি চালানো নিষেধ। বায়ু দূষণ রোধে তাদের এই মহতি উদ্যোগ। 

সর্ব সাধারণের চলাচলের জন্য তাদের নানা পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন Metro bus, বাস, কালেকট্রিভা ও ছোট্ট মিনি বাস, ট্রাক, সাবওয়ে/ মেট্রো: ট্যাক্সি, ইত্যাদি। সর্বত্রই মানুষহন, ভিড় অথচ অদ্ভুত শান্তি, নীরবতা তাদের চলাফেরায়। পাখির চোখে দেখা এই দেশের মানুষকে এতো অল্প সময়ে বর্ণনা করা কঠিন।  

প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ, ফূর্তিবাজ, রসিক ও ভোজনরসিক সবই আছে। মেহিকো শহরে ১৫০টির মতন জাদুঘর। শুধু জাদুঘর দেখেই এক জীবন পার হয়ে যাবে এখানে। জাদুঘরের কথা এলেই চলে আসে সেই দেশের অতীত ইতিহাস, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, যুদ্ধ, আর্তনাদ ইত্যাদি। চলুন জেনে নেয়া যাক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সময়কাল ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দ। স্প্যানিশরা উপনিবেশের নেশায় মত্ত। মেহিকোর প্রাচীন সভ্যতা, জীবন, নগর, পিরামিড, ঐশ্বর্য, সংস্কার, সংস্কৃতি, গৌরব যা কিছু ছিল নিষ্ঠুর স্প্যানিশার্ডরা চুরমার করে দিয়েছে। মায়া সভ্যতার সব অহংকার পরিণত হয়েছে ক্রীতদাসের আর্তনাদে। রাজা হয়েছেন দাস।
রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম একজন সফল কুটনৈতিক ও সজ্জন মানুষ। জ্ঞান ও চিত্রশিল্পেও রেখেছেন দক্ষতার ছোঁয়া। উনার কাছ থেকে দাওয়াত এলো বাংলাদেশ দূতাবাস এবং ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে একটি ফটো প্রদর্শনীর। যা শুরু হবে ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ থেকে। চলবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। আমাদের দু’জন সম্মানিত ফটোগ্রাফার মোস্তাফিজ মামুন ও আবুল মোমেনের ২০টি ছবি দিয়ে মেহিকো সিটির প্রাণকেন্দ্র পাসে দ্য ল্য রিফর্মা অ্যাভিনিউতে “বাংলাদেশ ইন ফ্রেমস” শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে যোগ দিতে আমি মেহিকো যাই ২৮ জানুয়ারি। মেহিকো আসার আগে প্রাক্তন বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান জানালেন, তিনিও মেহিকো যাচ্ছেন এবং উনার সাথে আরো দুইজন বাংলাদেশি শিল্পী, যাদের একটি পেইন্টিং এক্সিবিশন হবে মেহিকো সিটিতে। মাহফুজুর রহমান যখন পোলান্ডে রাষ্ট্রদূত ছিলেন তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার অতিথ্য গ্রহণের। পোলান্ডে থাকা এবং তার সাথে ওয়ারশ ঘুরে দেখার। অসম্ভব মেধাবী, বিনয়ী, দাবা বোর্ড সংগ্রাহক ও অনেক ভালো লেখক। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তার চারটি ভ্রমণ বিষয়ক বই বের হয়েছে। বাংলাদেশে দূতাবাসে কর্মরত শাহনাজ রানু ও মনিরুজ্জামানের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। আমাদের ভ্রমণ যাতে সুন্দর ও সফল হয় এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা অসামান্য। মুচাস গ্রাসিয়াস। 

এবার আসা যাক ভিসা প্রসঙ্গে। বাংলাদেশিদের মেহিকো যেতে ভিসা লাগে এবং সেই ভিসার জন্য নতুন দিল্লী, ভারতে যেতে হয়। তবে যাদের পাসপোর্ট ভ্যালিড, USA, Canada, UK, Schengen  ইত্যাদি যে কোন একটি দেশের মাল্টিপল ভিসা থাকলে তাদের মেহিকো যেতে ভিসা লাগবে না। তবে যেহেতু আমরা বাংলাদেশি, তাই অন্যান্য ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন রিটার্ন টিকিট, হোটেল বুকিং আমন্ত্রণ পত্র, টুর পরিকল্পনা ইত্যাদি সাথে থাকতে হবে। 

জানুয়ারি মাসে আমাদের ফটোগ্রাফার মুস্তাফিজ মামুনকে নিয়ে মিলান, ইতালিতে, বাংলাদেশ কনস্যুলেটে তার একক ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী, সেখান থেকে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ইউকে ভ্রমণ শেষে ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় এবং সেই দিনই টার্কিশ এয়ার লাইনসে মেহিকোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। মাঝে সাড়ে পনেরো ঘণ্টার ট্রানজিট। অগত্যা ইস্তাম্বুলে নেমে অনলাইনে ই-ভিসার আবেদন করি এবং তা অল্প সময়েই হয়ে যায়। পরে ইমিগ্রেশন শেষ করে টার্কিশ এয়ারলাইনের দুটি প্যাকেজ দিলো ট্রানজিট যাত্রীদের। একটি হবে শুধু হোটেল ও অন্যটি হবে ট্যুর। তবে দুটির সাথেই সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার থাকবে ফ্রি। যথেষ্ট ক্লান্ত বিধায় হোটেল বেছে নিলাম। তাদের নির্দিষ্ট মাইক্রোবাসে করে হোটেলে নিয়ে গেলো এবং বিশ্রাম নিয়ে পরে এয়ারপোর্টে এলাম। ইস্তাম্বুলে থেকেও দীর্ঘ পথ। ১৫ ঘণ্টা লাগবে মেহিকো যেতে। 

মেহিকো যখন পৌছাই তখন ভোররাত, বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে মনিরুজ্জামান এসেছেন রিসিভ করার জন্য। ইমিগ্রেশনে তেমন যাত্রী নেই, তবে কর্মপ্রক্রিয়া যথেষ্ট লম্বা। ইমিগ্রেশন পার হবার পর দেখি নিরাপত্তা রক্ষীরা প্রত্যেক যাত্রীর ব্যাগে কুকুর দিয়ে তল্লাশী করছেন। কাস্টমস অফিসার জানতে চাইলেন খাবার আছে কি না? মনিরের জন্য চানাচুর এনেছিলাম তারা আপত্তি জানিয়েছিল। বললাম, এটা ড্রাই ফুড, এস রেগালো (its gift)। আমার হালকা স্প্যানিশ শুনে তারা খুশি হল এবং তা দিয়ে দিল। সাড়ে ১৪ হাজার কি.মি. পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের চানাচুর এখন মুনিরের আস্তানায়।

মুনীর আমাকে তার বাসার কাছাকাছি একটি হোটেলে নিয়ে যায় এবং জানায় হোটেলের কাছে এক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ১২ কোটি ৬০ লক্ষের বসবাস মেক্সিকোতে। এখানেও ঢাকার মত যানজট হয়। তবে ভোর হওয়াতে তা টের পাইনি। বিশাল রাস্তা দেখে প্রথম দেখাতেই মেক্সিকোতে ভাল লাগলো। হোটেলের 7 eleven  I oxo  গ্রোসারি দোকান। সেটি দেখিয়ে দিল। রুমে এসে ওয়াই ফাই সংযোগ করি। দেশে বার্তা পাঠাই। ছোট ভাই আনিসুজ্জামান বিপ্লব জানাল আমাদের বড় মামা আলাউদ্দিন শিকদার মারা গেছেন। জীবন বড় মায়াময়। ভোরেই শাহনাজ রানু ম্যাসেজ দিল Teotihuacan পিরামিড দেখতে যাবো কিনা? পজেটিভ উত্তর দিলাম এবং জানালো মাহফুজ ভাই ও তার সঙ্গীরাও যাবে। লোকেশন শেয়ার করি Teotihuacan এ। সকাল ১০টার পরে ড্রাইভার এসে আমাকে নিয়ে যায়। আমরা মাহফুজ ভাইয়ের হোটেলের দিকে যাই যা শহরের ডাউন টাউন Bellas Artes এর কাছাকাছি। খুব প্রাণবন্ত ও ব্যস্ত এলাকা। আশেপাশে প্রচুর পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। মাহফুজ ভাই এলেন এবং তার দুই সফরসঙ্গীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যদিও একজনকে আমি আগে থেকে চিনি, তিনি হলেন গ্যালারি চিত্রকের মনির ভাই এবং অন্যজন হলেন শামসুল আলম ইনান। একজন চিত্র শিল্পী ও প্রিন্ট্রিং ব্যবসায়ী। (চলবে)

লেখক : আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন

 

শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী তীব্র সেশনজটের মহাশঙ্কা - dainik shiksha তীব্র সেশনজটের মহাশঙ্কা কলেজে ভর্তি : অতি চালাকদের শিক্ষাবোর্ডে ধরনা! - dainik shiksha কলেজে ভর্তি : অতি চালাকদের শিক্ষাবোর্ডে ধরনা! ক্যাম্পাস খুললে শিক্ষকরা কর্মসূচি চালু রাখবেন - dainik shiksha ক্যাম্পাস খুললে শিক্ষকরা কর্মসূচি চালু রাখবেন প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে কোটা, যা জানালেন সচিব - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে কোটা, যা জানালেন সচিব কলেজে ভর্তির সময় বাড়লো, ক্লাস শুরু ৬ আগস্ট - dainik shiksha কলেজে ভর্তির সময় বাড়লো, ক্লাস শুরু ৬ আগস্ট স্থগিত এইচএসসি পরীক্ষা ১১ আগস্টের পর - dainik shiksha স্থগিত এইচএসসি পরীক্ষা ১১ আগস্টের পর দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043199062347412