লাভবান নোট গাইড ও কোচিং সেন্টার - দৈনিকশিক্ষা

লাভবান নোট গাইড ও কোচিং সেন্টার

নিজস্ব প্রতিবেদক |

পাঠ্য বইয়ে নানা ধরনের অসংগতি ও ভুলে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এমনিতেই স্কুলগুলোতে খুব একটা পড়ালেখা হয় না। দ্বারস্থ হতে হয় কোচিং সেন্টার ও নোট-গাইডের ওপর। এবার শিক্ষার্থীদের সেই নির্ভরতা আরো বাড়বে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। ফলে নতুন করে কোচিং সেন্টার, নোট ও গাইডের ব্যবসার প্রসার ঘটবে বলে মনে করছে অনেকই।

জানা যায়, দেশের বেশির ভাগ স্কুলে শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ালেখা করাতে খুব বেশি আগ্রহী নন। এর বদলে তাঁরা শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারে যেতে প্ররোচিত করেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেটে যায় না এমন শিক্ষার্থীই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের ওপরও পুরোপুরি নির্ভরশীল। বিভিন্ন জরিপেও দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই কোনো না কোনোভাবে নোট বা গাইডের ওপর নির্ভর করে। এমনকি একজন শিক্ষার্থী একই বিষয়ের তিন-চারটি পর্যন্ত গাইড বই কিনে থাকে।

সূত্র জানায়, পাঠ্য বইয়ের ভুলে সুযোগ বুঝে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে কোচিং সেন্টার ও নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা। কোচিং সেন্টারগুলো সঠিকভাবে পড়ানোর কথা বলে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। যেকোনো অনুষ্ঠান বা স্কুল গেটেই কোচিং সেন্টারের প্রচারণামূলক লিফলেট এখন দেদার বিলি করা হচ্ছে। লিফলেটে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নানাভাবে প্ররোচিত করার প্রয়াস আছে। অপরদিকে চলতি মাসের শেষ নাগাদ ও আগামী মাসের প্রথম দিকেই বাজারে আসছে নোট, গাইড বা সহায়ক বই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো পাঠ্য বইয়ে যেসব ভুল আছে সেগুলো সংশোধন করেই তাদের গাইডে ছাপছে। এমনকি নির্ভুল গাইড বা সহায়ক বইয়ের প্রচারেও নানা রকম কৌশলের অবলম্বন করা হচ্ছে। স্কুলে স্কুলে ইতিমধ্যেই গাইডের প্রচারণা শুরু হয়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, মূলত আট-দশটি নোট-গাইড বা সহায়ক বই জমজমাট ব্যবসা করছে। এর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে চার-পাঁচটি প্রকাশনা সংস্থা। শিক্ষার্থীরা প্রতিটি বিষয়ের জন্য এসব প্রকাশনারই নোট-গাইড কিনে থাকে।

রাজধানীর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবার পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে অর্ণব। ওর বাবা কামরুজ্জামান  বলেন, ‘এ বছর ছেলের পিইসি পরীক্ষা। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকার সময়ও কোচিং করাতে হয়েছে। নোট-গাইডও কিনতে হয়েছে। কিন্তু এবার পাঠ্য বইয়ে যে ভুলের ছড়াছড়ি দেখছি তাতে আমরা খুবই চিন্তিত। তাই কোন কোন গাইড কিনব আর কোন কোচিংয়ে পড়াব তা এখন থেকেই খুঁজতে শুরু করেছি। ’

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মালিহার মা শামীমা সুলতানা বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় সাধারণত বাংলা বিষয়ের ভুলই দেখছি। কিন্তু আরো তো বিষয় রয়েছে। যদি বাংলায়ই এত ভুল থাকে তাহলে অন্যান্য বিষয়েও ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক। এখন সেগুলো ঠিক করে পড়াতে প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টারে দিতেই হবে। আর স্কুলে তো খুব একটা পড়ালেখা হয় না। নোট-গাইড তো অবশ্যই কিনতে হবে। আমি এরই মধ্যে লাইব্রেরিতে গিয়েছি। কিন্তু যে গাইডগুলো খুঁজেছি সেগুলো এখনো আসেনি। এলেই কিনতে হবে। ’

সূত্র জানায়, শিক্ষা আইনের খসড়া ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রথমদিকে কোচিং সেন্টার বন্ধে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হলেও পরবর্তী সময়ে তা বাতিল করা হয়। আর সহায়ক বই প্রকাশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়।

কয়েকজন অভিভাবক জানান, একদিকে কোচিং সেন্টার বন্ধে শাস্তির বিধান রাখা হয়নি অন্যদিকে বইয়ে ব্যাপক ভুলভ্রান্তি। ফলে সরকারই কোচিং সেন্টারে পড়ালেখা করাতে উৎসাহিত করছে। আবার সহায়ক বই প্রকাশেও তেমন একটা বাধা নেই। আর এনসিটিবি মূল পাঠ্য বইয়ে যেভাবে ভুল করেছে তাতে সহায়ক বইয়ের ক্ষেত্রে তাদের অনুমোদন নেওয়াটাও যুক্তিসংগত নয়। ফলে সরকার মুখে মুখে নোট-গাইড বন্ধের কথা বললেও বাস্তবতা তা বলে না। কারণ স্কুলে তেমন কোনো লেখাপড়া হয় না। শিক্ষকরাও অনেক কিছু বোঝেন না। তাঁরাও নোট-গাইডের দ্বারস্থ হন। বর্তমান পাঠ্য বইয়ের ভুলভ্রান্তিতে শিক্ষার্থীরা নোট-গাইডের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হবে।

জানা যায়, অনেক স্কুলের পড়ালেখাই এখন শিট বা ফটোকপি করা কাগজনির্ভর হয়ে গেছে। পাঠ্য বইয়ের বদলে সেখানে শিট দেওয়া হয়। যতটুকু পড়ানো হবে ততটুকুর শিট তৈরি করে শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া গ্রামের অনেক স্কুলেই মূল পাঠ্য বইয়ের বদলে সরাসরি নোট-গাইড পড়ানো হয়। এমনকি শিক্ষার্থীরা স্কুলে গাইড নিয়ে আসে। আর এবারের পাঠ্য বইয়ের নানা অসংগতি ও ভুলভ্রান্তিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আরো বেশি গাইডের দ্বারস্থ হবে।

এবার প্রতিটি শ্রেণির বেশির ভাগ বইয়েই ব্যাপক ভুল ধরা পড়ছে। প্রতিটি বইয়ের বানানেও অসংখ্য ভুল। পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে ‘ঘোষণা’ বানান ‘ঘোষনা’, ‘সমুদ্র’ বানান ‘সমুদ’ লেখা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় ইংরেজি নীতিবাক্য লেখা হয়েছে ভুল বানানে। ‘কাউকে কষ্ট দিও না’র ইংরেজি লেখা হয়েছে, DO NOT HEART ANYBODY. প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছে ছাগল নাকি গাছে উঠে আম খায়। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’, এর বদলে লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে’। কবিতার চতুর্থ লাইনে ‘মানুষ হইতে হবে-এই তার পণ’-এর ‘হইতে’ শব্দটিকে পাল্টে লেখা হয়েছে ‘হতেই’। নবম লাইনে ‘সে ছেলে কে চায় বল কথায়-কথায়’-এর ‘চায়’ শব্দটির বদলে লেখা হয়েছে ‘চাই’। পঞ্চদশ লাইনে ‘মনে প্রাণে খাট সবে শক্তি কর দান’-এর ‘খাট’-এর বদলে লেখা হয়েছে ‘খাটো’।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, বইয়ের বিভিন্ন ভুলভ্রান্তি চিহ্নিত করতে কাজ চলছে। এরপর কোনো এক প্রক্রিয়ায় ভুল সংশোধনের তালিকা প্রকাশ করা হবে। এ জন্য গণবিজ্ঞপ্তি, ওয়েবসাইটে প্রকাশসহ বিভিন্ন পন্থা ভাবা হচ্ছে। এবার বেশি ভুলের পৃষ্ঠাগুলো কেউ কেউ আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়ার যুক্তি দেখিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, ‘ছোটখাটো ভুলত্রুটির তালিকা প্রকাশ করা হলেও বড় ভুল ঠিকই থেকে যাবে। আর বইয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো যেসব লেখা যোগ করা হয়েছে তা শোধরানোর কোনো উপায় নেই। এগুলোই শিক্ষার্থীদের পড়তে হবে। আর আমাদের শিক্ষকরাও এত দক্ষ নয় যে তাঁরা নিজ থেকেই ভুলত্রুটি সংশোধন করে পড়াবেন। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই তাকিয়ে আছেন এখন নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের দিকে। ’

রাজধানীর কিশলয় স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ  বলেন, ‘ভুলভ্রান্তিতে পাঠ্য বইয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থা কিছুটা কমবে। তবে নোট-গাইড বা কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরতার জন্য আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। আমাদের পাঠ্য বই প্রণয়ন ও কারিকুলামে সমস্যা রয়েছে। কনটেন্টগুলোর ক্ষেত্রেও বড় সমস্যা আছে। কেন আমাদের আনন্দপাঠ বইয়ে সব বিদেশি গল্প দিতে হবে? আর শিক্ষার্থীদের টার্গেট এখন শিক্ষা নয়, বেশি নম্বর পাওয়া। এ জন্য তারা কোচিং সেন্টার ও নোট-গাইডের পেছনে দৌড়াচ্ছে। ’

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ  বলেন, ‘পাঠ্য বইয়ের ভুলত্রুটি প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে কোচিং সেন্টার ও নোট-গাইডের ওপর শিক্ষার্থীদের নির্ভরতা বাড়াবে। নোট-গাইড ব্যবসায়ীরাও সেই সুযোগ গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যে মিডিয়া বেশ কিছু ভুল চিহ্নিত করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, তারাও দ্রুত ভুল সংশোধনের তালিকা করবে। তাই শিক্ষার্থীদের যাতে কম ক্ষতি হয় সে জন্য মন্ত্রণালয়কে ত্বরিত প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। ’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান  বলেন, ‘আমরা আমাদের বাচ্চাদের কোনোভাবেই ভুল শেখাতে পারি না। এ জন্য দ্রুত সরকারকে শুদ্ধিপত্র পাঠাতে হবে। এটা না করা হলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পাঠ্য বইয়ের ওপর আস্থা আরো কিছুটা কমবে। ফলে তারা বিকল্প পন্থা গ্রহণ করবে। এত দিন হয়ে গেলেও কার পরামর্শ নিয়ে বিশাল পরিবর্তন আনা হলো সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয় নিশ্চুপ। আসলে শিক্ষা নিয়ে সব ধরনের ধান্দাবাজি বন্ধ করা উচিত। ’

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030419826507568