লিফলেট ছড়িয়ে কোচিং বাণিজ্য শুরু করেছেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল ও খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৩ জন শিক্ষক। সরকারি ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে’ ৬ষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি কোচিং করাচ্ছেন তারা। আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে শিক্ষকরা দিচ্ছেন ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন কমনসহ সরকারি স্কুলে ভর্তির গ্যারান্টি। রীতিমত ‘ঢাক ঢোল পিটিয়ে’ উচ্চ আদালত ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষকদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সর্বমহলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ আদালত থেকে দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের শিক্ষকরা কোচিং করাতে পারবেন না। সে প্রেক্ষিতে সরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নির্দেশনা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালাও জারি করা হয়েছে। কিন্তু এসব নির্দেশনার কিছুই মানছেন না গফরগাঁওয়ের ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল ও খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এ ১৩ শিক্ষক।
অভিযোগ, এই কোচিংবাজ শিক্ষকদের কাছে কোচিং করা শিক্ষার্থীরা অনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকে। ফলে ওই শিক্ষকদের কাছে কোচিং করা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী এই দুই সরকারি হাই ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। এতে করে ভর্তি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা। হচ্ছে না মেধার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন। আর প্রশাসনের নাকের ডগায় কোচিং নীতিমালা উপেক্ষা করে একেকজন শিক্ষক ১৮ থেকে ২০ দিনে হাতিয়ে নিচ্ছেন দুই থেকে পৌনে চার লাখ টাকা করে।
মো. রুকুনুজ্জামান নামে এক অভিভাবক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, শিক্ষকরা নিয়ম ভেঙে কোচিং বাণিজ্য করছেন। এমনকি ভর্তির গ্যারান্টি দিচ্ছেন! উচ্চ আদালত ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক উপপরিচালক, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, ওই শিক্ষকরা নিজেরাই খাতা মূল্যায়ন করবেন। তাই তাদের এখানে কোচিং করালে সন্তানদের ভর্তি নিশ্চিত, অভিভাবকদের এমন প্রলোভন দেখিয়ে কোচিংয়ে টানছেন ওই দুই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কোচিংবাজ শিক্ষকরা। এতে প্রতারিত হচ্ছেন পৌর এলাকার দুই সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। আর সুযোগ বুঝে শিক্ষকরা হাতিয়ে নিচ্ছেন কয়েকলাখ টাকা।
গত ২৪ নভেম্বর প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পৌর শহরের দুই সরকারি প্রতিষ্ঠান গফরগাঁও ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল এবং খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অভিভাবকদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। এই দুই প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তির জন্য সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছেই ছুটে যান অভিভাবকরা। তাদের কাছে ১৮ থেকে ২০ দিন পড়ালেই ভর্তির সুযোগ হতে পারে, এমন ধারণা করে প্রতি বছর প্রতারিত হন অধিকাংশ অভিভাবক। কারণ ৬ষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় ৫ম শ্রেণির বই থেকেই প্রশ্ন করা হয়। আর ভর্তি কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকরা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। গত বছর পর্যন্ত অতি গোপনে ওই দুই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোচিং চালালেও এবার লিফলেট ছেড়ে ভর্তিচ্ছু ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে টানছেন তারা।
এই দুই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীরা অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন ফরম পূরণ করেন। পরে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ১২০ জন করে ভর্তি করানোর নিয়ম থাকলেও মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগও রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গফরগাঁও ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল এবং খায়রুল্লাহ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৩ জন শিক্ষক সরাসরি এই ভর্তি কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক আবু সায়িদ, ইংরেজির শিক্ষক মিজানুর রহমান, গণিতের শিক্ষক রাশিদুজ্জামান ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুলের পুরাতন ছাত্রাবাসে কোচিং সেন্টার খুলে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীকে কোচিং করান। ইংরেজির শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম শতাধিক, একই বিষয়ের শিক্ষক রোকসানা ইয়াছমিন অর্ধশতাধিক ও গণিতের শিক্ষক আফরোজা বেগম অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ বাসায় ভর্তি কোচিং করাচ্ছেন।
খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক খোরশেদুজ্জামান প্রায় একশ জন, গণিতের শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান প্রায় পঞ্চাশ জন, গণিতের শিক্ষক কবির আহমেদ ৪০ জন, জীববিজ্ঞানের শিক্ষক মাহমুদা বেগম অর্ধশতাধিক, ইংরেজির শিক্ষক মামুনুর রশিদ অর্ধশতাধিক, গণিতের শিক্ষক হাসিনা মমতাজ ৩৫ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ বাসা-বাড়িতে কোচিং করান। ১৮ থেকে ২০ দিন পড়ানোর বিনিময়ে এসব শিক্ষার্থীর প্রতিজনের কাছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার করে টাকা নেয়া হয়। মাত্র ১৮-২০ দিনে ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে একেকজন শিক্ষক হাতিয়ে নেন পৌনে দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা।
ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক আবু সাঈদ স্বীকার করে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘কোচিং করানো সরকারিভাবে নিষেধ রয়েছে। ১৫-২০ দিনের জন্য সবাই কোচিং করাচ্ছে তাই আমিও করাচ্ছি।’
খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রহিমা খাতুন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন,‘প্রাইভেট কোচিং নীতিমালা অনুযায়ী স্কুলে কারও কোচিং করানোর সুযোগ নেই। আমাদের পাশাপাশি আপনাদেরও দেখার দায়িত্ব রয়েছে।’
ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘সরকারি নীতিমালা অমান্য করে অবৈধ কোচিং বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের দায় স্কুল কতৃপক্ষ নেবে না।’
গফরগাঁওয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মাহবুব উর রহমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব শিক্ষক ভর্তি কোচিং করান, তাদের আসলে নীতি আদর্শ বলে কিছু নেই। কোচিং বন্ধে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে এরই মধ্যে বলা হয়েছে। পাশাপাশি মাইকিং করা হবে।’