শব্দদূষণ সুস্থ মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধক - দৈনিকশিক্ষা

শব্দদূষণ সুস্থ মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধক

মো. জিল্লুর রহমান |

ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার শব্দ দূষণের মাত্রা ৮৬ ডেসিবল থেকে ১১০ ডেসিবল পর্যন্তু। কোনো কোনো স্থানে ১১০ ডেসিবলের চেয়েও বেশি। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে বেড়েই চলেছে এই মাত্রা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবলের মধ্যে। দেশে শব্দদূষণ আইন প্রণয়ন করা হলেও এখন পর্যন্ত এর কার্যকর প্রয়োগ দৃশ্যমান হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক সময়ে বায়ুদূষণের পর রাজধানী শহর ঢাকা শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। 

শব্দদূষণ নিয়ে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে শব্দদূষণ কীভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা প্রভাবিত করছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ শহরের তিনটির অবস্থানই দক্ষিণ এশিয়ায়। শব্দদূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দখল করেছে যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। শব্দদূষণে বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী- রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর পঞ্চম অবস্থানে ভিয়েতনমের হো চি মিন শহর। এর আগে একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় ১ নম্বর তালিকায় স্থান করে নেয় রাজধানী ঢাকা এবং সর্বশেষ মার্চের মাঝামাঝি সময়ে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় উঠে আসে। এসব তথ্য সত্যিই বেশ পীড়াদায়ক ও  উদ্বেগজনক।

 

উল্লেখিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন বা নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। শব্দদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে যানজটকালে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট শব্দ। এসব শব্দ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

আসলে নীরব ঘাতক উচ্চমাত্রার হর্ন বা এ জাতীয় শব্দ দূষণের মাত্রা রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে নতুন কোন বিষয় নয়। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা এখন বিস্ফোরক আকার ধারণ করেছে। শহরের যানবাহন, যানবাহনের হর্ন, মাইক, লাউড-স্পিকার, ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন, জেনারেটর ইত্যাদি থেকে নির্গত শব্দ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শব্দ সন্ত্রাসের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুর শ্রবণক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বিধি বিধান থাকলেও তার তেমন কোনো প্রয়োগ হচ্ছে না। 

ঢাকা নগরীর রাজপথ থেকে আবাসিক এলাকা- সর্বত্রই শব্দদূষণের ফলে জটিল ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শব্দ দূষণের ফলে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিরোধ করতে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করা হলেও যানবাহন মালিক, চালকরা এগুলো মানছেন না। স্কুল কিংবা হাসপাতালের সামনে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ হলেও কে শোনে কার কথা ! অব্যাহত যানজট শব্দ দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দদূষণ প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা করছে, জরিমানা করছে, কিন্তু শব্দদূষণ বন্ধ করতে পারছে না। যানবাহনের দুর্ভোগের সাথে যুক্ত হয়েছে জেনারেটরের বিকট শব্দ, যা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের একটি অন্যতম জনবহুল ও অপরিকল্পিত মহানগর। হাসপাতালে যখন চিকিৎসা চলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন পাঠদান চলে, তখন রাস্তায় দেখা যায়, রাস্তায় মাইক ব্যবহার করে বক্তৃতা হচ্ছে, মাইক দিয়ে গান বাজিয়ে লটারির টিকিট বিক্রি হচ্ছে, কারণে-অকারণে বাস ও ট্রাকচালকেরা হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে বাইরে থেকে হাসপাতালের ভেতর শব্দদূষণ করছে, রাজনৈতিক সভাসমাবেশের গগনবিদারী শব্দ প্রতিনিয়ত মানুষকে বিব্রত করছে। এসব চিত্র অত্যন্ত বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক এবং এর থেকে নিস্তার দরকার। মনে হয় যেন এগুলো দেখার ও তদারকির কেউ নেই!

শিল্প এলাকায় শব্দের সহনীয় মাত্রা দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় ৫০ ও ৪০ ডেসিবল এবং নিরব এলাকায় (হাসপাতাল ও স্কুল আছে এমন এলাকা) ৪৫ ও ৩৫ ডেসিবল। এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়,  ঢাকা শহরের ৪৮টি পয়েন্টে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ১৫টি পয়েন্টে শব্দমাত্রা থাকে ৮০ ডেসিবলের ওপরে। ১০টি পয়েন্টে শব্দমাত্রা থাকে ৭১ থেকে ৮০ ডেসিবল, ১৩টি স্পটে ৬১ থেকে ৭০ ডেসিবল, ৯টি পয়েন্টে ৫১ থেকে ৬০ ডিসেবল এবং ১টি পয়েন্টে ৪৫ থেকে ৫০ ডেসিবল শব্দমাত্রা থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কেবল ১০টি পয়েন্টে শব্দমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক বাড়িতে ও শোবার ঘরে শব্দের মাত্রা ২৫ ডেসিবল, অন্যান্য রুমে ৪০ ডেসিবল, হাসপাতালে ২০ থেকে ৩০ ডেসিবল, রেস্টুরেন্টে ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল, অফিস কক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ ডেসিবল এবং শ্রেণীকক্ষে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবল থাকা স্বাস্থ্যসম্মত। এর চেয়ে বেশি হলে সেটা শব্দ দূষণের পর্যায়ে পড়ে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সূত্রে জানা যায়, ৩০টি কঠিন রোগের কারণ বারো রকমের পরিবেশ দূষণ। শব্দদূষণ তার মধ্যে অন্যতম। শব্দদূষণের প্রধান উৎস গাড়ির হর্ন। এ ছাড়া ইট ভাঙার মেশিন, জেনারেটর, মাইকের শব্দ, কারখানার শব্দ, উচ্চ শব্দে গান শোনা ইত্যাদি নানাভাবে শব্দদূষণ সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিছুদিন ধরে বিকট শব্দে হর্ন বাজানো যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। মোটর সাইকেলে শোনা যায় কুকুর বা গাধার ডাক, প্রাইভেট কারে গাড়ি ব্রেকের শব্দ। পেছন থেকে হঠাৎ এমন শব্দ শুনলে সামনের পথচারীর শোচনীয় অবস্থা। 

স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শব্দদূষণের কারণে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, খিটখিটে মেজাজ, মাথাব্যথা, পেপটিক আলসার, অস্থিরতা, অমনোযোগী ভাব, ঘুমে ব্যাঘাত, শ্রবণশক্তি ও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ মানুষের লিভার সিরোসিস, গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, রক্তচাপজনিত রোগ, মাথা ধরা, মনোযোগ নষ্টসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে।

শব্দদূষণের ফলে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের সমস্যাই দেখা দেয় এবং এটা হতে পারে স্থায়ী বা অস্থায়ী। হঠাৎ কোনো উচ্চ শব্দে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে এবং সঙ্গে রক্তক্ষরণও হতে পারে। উচ্চ শব্দে কানের মধ্যে ইনফ্লামেশন হয়ে ইফিওশন হতে পারে। উচ্চ শব্দের উৎসের কাছে দীর্ঘদিন কাজ করলে একজন মানুষের শ্রবণক্ষমতা স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হতে পারে। রোগী, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য শব্দদূষণ মারাত্মক ক্ষতির কারণ। শব্দদূষণের কারণে বিকলাঙ্গ শিশুও জন্মগ্রহণ করতে পারে। প্রচণ্ড শব্দ শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে। কোনো শিশুর কানে যদি খুব কাছ থেকে উচ্চ শব্দ আসে, তাহলে তার শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

শব্দদূষণের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুর শ্রবণক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে। এর প্রতিকার জরুরি। শব্দ দূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে শব্দদূষণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও সেটা রয়েছে শুধু কাগজে কলমে। বিধি অনুযায়ি হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা- সেইসঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয়। এছাড়া, ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইনে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং নির্ধারিত স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত নিরব এলাকা হিসেবে নির্দিষ্ট রাখার বিধান রয়েছে। তবে সেই আইনের কোন প্রয়োগ নেই। শব্দ দূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পেছনে একেই প্রধান কারণ হিসেবে দায়ি করা হচ্ছে। শব্দদূষণ সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ না থাকায় এ ধরনের গাড়ির হর্ন বাজানোসহ লাউড স্পিকার ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। শব্দদূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য সকলকে সচেতন হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোরও প্রয়োজনীয় তদারকি ও পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

লেখক : মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও কলামিস্ট 

 

এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003187894821167