শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড হলে শিক্ষক হবেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। মাঝি বিহীন তরী যেমন চলতে পারে না ঠিক তেমনি শিক্ষক বিহীন শিক্ষা চলতে পারে না। শিক্ষকতা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এই মহান পেশায় সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষকদেরকে সম্মানের চোখে দেখে আসছেন মানুষ। মহান এ পেশায় নিয়োজিত ব্যাক্তিবর্গ হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকরা মানুষ গড়েন আর সেই মানুষরা দেশ জাতি ও সভ্যতা গড়েন।
বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, যিনি জানেন, তিনি করেন, যিনি বোঝেন, তিনি পড়ান। শিক্ষক সমগ্র জীবন ভর অন্ধকারের পাদপীঠে আলো জ্বালিয়ে শেষ করেন তার কর্মজীবন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, তিনি সমগ্র জীবনে অন্যের অন্ধকার দূর করতে আলো জ্বালাতে গিয়ে তার নিজের নিজের জীবনের অন্ধকার আর্থিক সংকট ঘোচাতে পারেন না।
এর ফলে শিক্ষকতা পেশায় সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তাজনিত কারণে মেধাবীরা তেমন একটা আসতে চান না, যারা আসেন তার বেশির ভাগই অনন্যোপায় হয়ে এখানে আসেন। এ ছাড়া আরো অনেক কারণ রয়েছে যার জন্য আমাদের দেশের মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না। আমাদের দেশে দিনদিন শিক্ষা আধুনিকায়ন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষকদের জীবন-মানে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন বা আধুনিকায়ন হচ্ছে না। সরকার শিক্ষকতায় পূর্বের সরকারের তুলনায় অনেক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে তা সত্য, কিন্তু অন্যান্য পেশার সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে তুলনামূলক বিবেচনায় তা নগন্য।
বিশেষ করে বলা যায়, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকরা এখনো সরকারি-বেসরকারি, এমপিও, নন-এমপিওসহ বিভিন্ন শ্রেণির উপাধিতে পরিচিত, যার মূল কারণ হচ্ছে আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তি।
বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তরণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের হার সমগ্র বিশ্বে দ্বিতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও অংশগ্রহণ করে করে মোট মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৪ শতাংশ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার ৫৫ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় এটি ৩৬ শতাংশ । যারা বেসরকারি পর্যায়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিরাট একটি অংশ পরিচালনা করে সে সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও পেনশন নিয়ে কাজ করে হতাশা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের থেকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির দিকে অনেক পিছিয়ে তারা। ফলে একই কারিকুলামে পাঠদান করেও শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের বৈষম্য বিরাজ করছে।
একই যোগ্যতায় সমপর্যায়ে প্রতিষ্ঠানে একজন সরকারি শিক্ষক ও বেসরকারি শিক্ষকের বেতন, বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা ও পেনশনে দেখা যায় আকাশ-পাতাল ফারাক। এখান থেকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি মানুষের এক ধরনের অনিহা চলে আসে যা উন্নত শিক্ষার প্রতি অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যাবস্থায় উন্নত কারিকুলাম বাস্তবায়নে প্রথমত শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করার বিকল্প নেই।
শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে আধুনিক ধ্যান-ধারণার প্রয়োগের পাশাপাশি শিক্ষকতায় বৈষম্য কমিয়ে একটা ভারসাম্য আনয়ন আজ সময়ের দাবি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে আগে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও মানবিকতা সম্পন্ন দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে হবে। আর এই মহান দায়িত্বটির বেশির ভাগ যাদের কাছে ন্যস্ত তাদের জীবনমানের উন্নয়ন করা আজ সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর