শিক্ষকরা সৃজনশীল না বুঝলে পড়াবেন কী করে? - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকরা সৃজনশীল না বুঝলে পড়াবেন কী করে?

মহসিনা হোসেইন |

গত ২৩ আগস্ট একটি  জাতীয় দৈনিকের  খবরে চোখ আটকে গেল। শিরোনাম ছিল, ‘৫২ শতাংশ স্কুলের শিক্ষকই সৃজনশীল বোঝেন না’। খবরে প্রকাশ, গড়ে দেশের ৫২.০৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না বলে উঠে এসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের একাডেমিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ৩০.৮৯ শতাংশ শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্ন তৈরি করেন। আর সমিতি থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ২১.১৭ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। গত মে মাসে ১৮ হাজার ৫৯৮টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ছয় হাজার ৬৭৬টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার ভিত্তিতে মাউশি অধিদপ্তর এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এর আগের বছরগুলোর পরিসংখ্যানও সুখকর নয়।

এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৃজনশীল ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছেন বরিশাল অঞ্চলের শিক্ষকরা। আঁতকে ওঠার মতো বিষয়, ওই অঞ্চলের ৭৯.২৪ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকই নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। ঢাকা বিভাগের ৫২.৫১ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। আর এই হার ময়মনসিংহ বিভাগে ৭৬.৫৫, সিলেটে ২৮.১৪, চট্টগ্রামে ৫০.৯৪, রংপুরে ৫০.৫২, রাজশাহীতে ৪৬.৫৬, খুলনায় ৩৫.১২, বরিশালে ৭৯.২৪ এবং কুমিল্লায় ২৭.১৮ শতাংশ।

ছাত্র-ছাত্রীরা সৃজনশীলে কাঁচা মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষকই এ পদ্ধতি বোঝেন না, এটা মেনে নেওয়া সত্যি কঠিন।
ভয়ংকর তথ্য, অনেক শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করেন গাইড বইয়ের নমুনা প্রশ্ন সামনে রেখে। আবার কোনো কোনো শিক্ষক অন্য স্কুলের প্রশ্ন ধার নেন। বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনেও পরীক্ষা নেয় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষকরা নিজেরাই যদি সৃজনশীল পদ্ধতি না বোঝেন, প্রশ্ন করার দক্ষতা না রাখেন, ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাবেন কী করে? উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়নই বা করবেন কিভাবে? বিষয়টি আমাদের আরো বেশি ভাবিয়ে তোলে যখন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নও করা হয় গাইড বই থেকে। একবার এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্ন গাইড বই থেকে হুবহু তুলে দেওয়া হলে বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। আরেকবার অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় গাইড বইয়ের প্রশ্ন হুবহু প্রশ্নপত্রে জুড়ে দেওয়ার শাস্তি হিসেবে এক শিক্ষককে ফেনী থেকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়েছিল।

পাবলিক পরীক্ষা দূরের কথা, স্কুল-কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে প্রশ্ন না করার ব্যাপারে একাধিকবার সরকারি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। বাইরে থেকে প্রশ্ন না কেনার ব্যাপারেও নির্দেশনা আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। অথচ এখনো অনেক শিক্ষক প্রশ্ন তৈরি করেন গাইড বইয়ের সাহায্য নিয়ে। শিক্ষকরা অন্য স্কুলের প্রশ্ন ধার নেন, সমিতি থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম চালু হয়েছিল সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি। বাংলা ও ধর্মশিক্ষা প্রথমবারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতির আওতায় আসে। ক্রমান্বয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। প্রাথমিক স্তরে সৃজনশীলের আদলে চালু করা হয় যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন। কিন্তু অবাক করা বিষয়, সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর এত বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষাগুরুরাই এখনো সৃজনশীল বোঝেন না!

শিক্ষকরা বলছেন, তাঁরা সৃজনশীল বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাননি। এ কারণে ঠিকঠাক পড়াতে পারছেন না, প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারছেন না। অনেক শিক্ষকের অভিযোগ, সৃজনশীল পদ্ধতির জন্য তিন দিনের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়। যে সময় ধরে প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা, তা-ও হয় না। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নামকাওয়াস্তে। যাঁরা প্রশিক্ষণ দেন, তাঁদের অনেকে নিজেরাই বিষয়টি বোঝেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। বইয়ে পর্যাপ্ত উদাহরণের অভাব রয়েছে বলেও অভিযোগ অনেক শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকের। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাহলে গলদটা কোথায়? এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। ভালো উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে শিক্ষকদের সৃজনশীল না হয়ে ওঠার কারণে। সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষকদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আশা করাও বৃথা।

প্রশ্ন পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞানতা, গাইডনির্ভরতা, প্রশ্নবিদ্ধ খাতার মূল্যায়ন এ পদ্ধতিকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরাও বলছে, শিক্ষকরা ক্লাসে পড়াতে পারছেন না। আগে যেখানে তারা একটি গাইড কিনত, এখন সৃজনশীলের ভয়ে একাধিক গাইড কিনছে। অভিভাবকদের মধ্যেও আছে সৃজনশীলের ভীতি। তাঁরা নিজেরাও পদ্ধতিটা বোঝেন না, বাসায় ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করতে পারেন না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময়সভায় বাংলাদেশে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর অন্যতম পুরোধা শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্বয়ং স্বীকার করেছেন, শিক্ষকরা সৃজনশীলতা বোঝেন না। তাঁরা জানেন না কিভাবে পড়াতে হবে। কিভাবে প্রশ্ন করতে হবে। সে কারণে শিক্ষকরা ঝুঁকছেন গাইড বইয়ের দিকে। শিক্ষার্থীদেরও তাঁরা বোঝাতে পারেন না। অভিভাবক ছুটছেন কোচিং সেন্টারের দিকে, প্রাইভেট টিউটরের দিকে।

ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক—সবার মধ্যে কাজ করে সৃজনশীলভীতি। অথচ কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখলেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে ভালো নম্বর পাওয়া যায়। সঠিক নিয়মে উত্তর লিখলে ৯০ শতাংশেরও বেশি নম্বর তোলা সম্ভব।

সৃজনশীল পদ্ধতিকে কার্যকর করার জন্য শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী কারিকুলাম ঠিক করাটা জরুরি। যারা সৃজনশীলের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হতে যাচ্ছে, তাদের প্রথমেই উচ্চমানের প্রশ্ন করে ভয় পাইয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। নিচের ক্লাসের বইগুলোতে সহজ কিছু উদাহরণ দিয়ে এটা শুরু করা যেতে পারে। সব শ্রেণির বইয়ে উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত উদাহরণ থাকতে হবে, যাতে একটি দেখে আরো প্রশ্ন ও উত্তর নিজেরাই করতে পারে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা। প্রয়োজনীয় সূত্র, সংকেত, তত্ত্ব, নিয়ম, পরিসংখ্যান, পরীক্ষার প্রয়োগ হাইলাইট করে দিলেও সুফল মিলতে পারে।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক—সবার সচেতনতাও জরুরি। নামকাওয়াস্তে নয়, শিক্ষকদের জন্য চাই কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে পারলেই ক্লাসে বোঝাতে পারবেন, প্রশ্ন তৈরি করতে পারবেন।

লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036990642547607