ছাত্র হয়ে শিক্ষকের ভুল ধরা যাবে না, সেটা করলে যেন পাপ হবে এবং শিক্ষাজীবন বরবাদ হয়ে যাবে। শিক্ষাজীবন বরবাদ যেন না হয় তাই দিনের পর দিন আমরা শিক্ষকের ভুল দেখেও মুখ খুলিনি। পাপের ভয়ে আমরা আজীবন ভুল শিখেছি, ভুল জেনেছি, ভুলভাবে বড় হয়েছি।
দেশ এখন রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। তার মাঝে আমি ভুল নিয়ে তবে কি ভুলভাল বকছি? কিছুদিন আগে কোনো একটি টিভি চ্যানেলের করা একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কিছু সাধারণ প্রশ্ন করা হয়েছিল কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। আর এতেই সারা দেশ ফুসে উঠল, শিক্ষা ব্যবস্থাকে গালিগালাজ করল, শিক্ষামন্ত্রীকে ধুয়ে দিল যেন সব দোষ শিক্ষামন্ত্রীর আর সরকারের। আমরা সেই টেলিভিশন চ্যানেলের পেজে, সাইটে গিয়ে একটু খোঁজ নিতেই দেখতে পেলাম দুই লাইন লেখায় তিনটা বানান ভুল। যেহেতু তারাই নেমেছেন ভুল ধরতে সেহেতু তাদের ভুলগুলো কে ধরবেন তার দায়িত্ব সম্ভবত তারা বণ্টন করেননি তখনো। অগত্যা সেটা নিয়েও খুব হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে গেল এবং তারা তখন শুধরে নিলেন। এর পর জানা গেল সেই নিউজটাও নাকি ভুয়া ছিল।
আমাদের প্রশ্নপত্রে ভুল, স্কুল কলেজের বইয়ে ভুল, রাস্তায় রাস্তায় অলিতে গলিতে পোস্টার ব্যানারে ভুল। বুকের উপর সেফটি পিন দিয়ে আটকে রাখা নেমপ্লেটে ভুল। চলনে-বলনে ভুল, আচার-আচরণে ভুল। আমাদের জীবনটাই যেন ভুলের রাজ্য হয়ে উঠেছে। আচ্ছা, আমাদের কী দোষ বলুন। যে বই পড়ে আমরা জ্ঞানী হব বলে ভেবেছি সেই বইয়ে ভুল থাকলে আমরাতো ভুলই শিখব। যে প্রশ্নে ভুল থাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিলে আমরাতো ভুল উত্তরই দেব। আর যে শিক্ষক আমাদের পড়ান তিনি ভুল করলে কী হবে? অবশ্যই আমরা ভুল শিখব কিন্তু তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ শিক্ষকের ভুল ধরাও ভুল। এটা যেন মস্তবড় পাপ। এই ভুলের রাজ্যে কারো কারো হয়তো সেই ছাত্রটির মত মতিগতি বিগড়ে যেতে পারে। স্কুল থেকে ফিরে এক ছাত্র তার বাবাকে বলল, বাবা কাল থেকে আর স্কুলে যাব না। যাচ্ছেতাই ব্যাপার, খুবই বিরক্তিকর। কারো মধ্যে কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই, কেউ দায়িত্ববান নয়, সবাই একটা মিথ্যাবাদী। ছেলের কথা শুনে বাবাতো ভীষণ অবাক। জানতে চাইলেন কী হয়েছে সেটা আগে খুলে বল, তার পর ভেবে দেখা যাবে- তুমি স্কুলে যাবে কি যাবে না। ছেলেটি বলল, স্কুলে যাব কী করে? যে স্কুলের শিক্ষকেরা সামান্য একটি বিষয়ে একমত হতে পারে না, সেই স্কুলে গিয়ে আমি কী শিখব তাইতো বুঝতে পারছি না। ক্লাসে আইসিটি স্যার বললেন, সেল মানে হলো মোবাইল ফোন। পরের পিরিয়ডে বিজ্ঞান স্যার বললেন, সেল মানে হলো কোষ। গণিত স্যার বললেন, সেল মানে হলো বিক্রয়। সমাজ বিজ্ঞান স্যার বললেন, সেল মানে হলো জেলখানা। যেখানে এক সেল কথাটাকেই স্যারেরা সবাই মিলে এক অর্থে মেনে নিতে পারছে না, সেখানে গিয়ে আমি কী শিখব?
যদিও এখানে শিক্ষকের ভুল নয়, ছাত্রের ভুল। বুঝতে না পারার ভুল। তবে ছোটবেলায় ছোটখাট ভুলের কারণে কতবার যে দুই হাতে বেতের বাড়ি পড়ে লাল হয়ে গেছে তার হিসেব নেই। সেই সব বেতের বাড়ির দাগ কবেই মুছে গেছে কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে। তখন না হয় ছোট ছিলাম এবং সেই সব শিক্ষকও সবাই অল্প শিক্ষিত ছিলেন তাই ভুলগুলো মেনে নেওয়াই যেতে পারে। কিন্তু এখনকার আধুনিক শিক্ষকেরাতো উচ্চ শিক্ষিত। তারা প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, তারা সেরাদের সেরা। তারা কী করে ভুল করেন? ভুল করলে অবশ্য দোষ নেই। কিন্তু তারা সেটা দিনের পর দিন কী করে চালিয়ে যান? শুধরে নিতে পারেন না? তার মানে হলো তিনি বা তারা যে ভুল করছেন সেটাই হয়তো তারা এখনও বুঝতে পারছেন না। এই যে বুঝতে না পারাটা কি অন্যায় হবে? নাহ তা হবে কেন? কিন্তু আমি যে তাদের ভুলের কথা বলছি এটা খুবই অন্যায় হচ্ছে,আমার শিক্ষাজীবন বরবাদ হয়ে যাবে।
শিক্ষকের ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তখনকার মত কিছু নাও বলতে পারেন কিন্তু মনে মনে তার একটা গান ঠিকই মুখস্থ আছে, তিনি সেটা বেশ সুর করে গাইতে থাকবেন—‘তুমি আমার ঘুড়ি আমি তোমার লাটাই, যেদিকেই উড়ে বেড়াও,আমার আকাশ পুরোটাই’। তার মানে হলো তুমি যত খুশি আমার ভুল ধর পরীক্ষার খাতাতো আমার হাতেই আসবে। কী করে কত নাম্বার পাও সেটা দেখিয়ে দেব। এইতো গত বছর যারা এইচএসসি পাস করল তাদের পরীক্ষার খাতা দেখেছে তাদেরই মত ছাত্র-ছাত্রীরা। এ খবর পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের সবারই জানা। শিক্ষক নিজে না দেখে অন্যকে দিয়ে দেখাচ্ছেন এটাতো ভারি অন্যায়। কিন্তু এই অন্যায় ধরা যাবে না।।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের কাছে পিএইচডি থিসিস জমা দিলাম তারা সবাই বিজ্ঞজন এটা মানতেই হবে। থিসিস পেপার উপস্থাপনের সময় দাড়ি, কমা, সেমিকোলন কোথাও ছুটে গেলেই থামিয়ে দিচ্ছেন, কথা শোনাতে পিছপা হচ্ছেন না। ঠিক সেই গুণীজনদের তত্ত্বাবধানে যখন একটা সংকলন বের হচ্ছে সেখানে কোনো দাড়ি, কমা, সেমিকোলনের ভুল নয়, কোনো শব্দ গঠনের ভুল নয় সরাসরি একটি মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ কেউ কিছু মনেই করছেন না। যারা থিসিস পেপারের দাড়ি, কমা, সেমিকোলনের ভুল ধরে নাজেহাল করে ছাড়ছেন, তারাই একটি সংকলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বার কয়েক পুরুফ দেখে ছাপিয়ে দিচ্ছেন সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা তাতে তাদের কোনো দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ তারা শিক্ষক এবং শিক্ষকের ভুল ধরাটাই যেন ভুল।
লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়