শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষার্থীর গৌরবে - Dainikshiksha

শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষার্থীর গৌরবে

গোলাম কবির |

শিক্ষককে ছাপিয়ে শিক্ষার্থীর গৌরব ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য রয়েছে। আমার অকৃতী-শিক্ষকতা জীবনে এমন কৃতী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়। মিজারুল কায়েস তাঁদের অন্যতম। মা-বাবা তাঁকে ডাকতেন পান্না বলে। এই ডাকনামটি তাঁর সীমিত বন্ধু মহলে পরিচিত ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, তিনি হীরা-পান্নার মতোই ছিলেন দ্যুতিময়।

অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ রাজশাহী কলেজ। এখানে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ঘটত। প্রতিবছরই রাজশাহী কলেজ থেকে একঝাঁক মেধাবী শিক্ষার্থী বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কামিয়াব হয়ে কাঙ্ক্ষিত কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। সবাই মেধাবী। সুতরাং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তাঁরা দেশ-বিদেশে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মিজারুল কায়েস তাঁদের মধ্যে অন্যতম ও ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী এ জন্য যে বিদেশ মন্ত্রণালয়ে চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের ঔজ্জ্বল্য ও স্বকীয়তা যেমন তিনি বিদেশে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন, তেমনি বিশ্বসাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতিকে নিবিড়ভাবে মন্থন করে নীলকণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতার গভীরতা থেকে সংশ্লিষ্টজন তাঁকে প্রাজ্ঞ হিসেবেই জেনেছেন। তাঁর বোধের বিষয়গুলো মলাটবদ্ধ করেননি। ‘আমার সময় হয় নাই, হয় নাই’ রবীন্দ্রসংগীতের এই চরণটি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, চাকরি শেষে দুই বছর পরে দেশে এসে আপনাদের সঙ্গে প্রাণের উপলব্ধি ভাগাভাগি করে নেব। নিয়তি সে সময় তাঁকে দেয়নি।

বাবার কর্মস্থল রাজশাহী হওয়ায় কিশোরগঞ্জের শ্যামল রঙের প্রতিভাদীপ্ত ছেলেটি রাজশাহী কলেজের ১৯৭৫-৭৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। এখানে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।

রাজশাহী কলেজে মিজারুল কায়েসদের আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও ছোটগল্প পড়াতাম। ওঁর সহপাঠী হাসানুল বান্না, সজল প্রায় দিনই পাশাপাশি বসতেন। তাঁরা মাঝেমধ্যে দুষ্টুমি করতেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের দুষ্টুমিতেও একটা আর্ট ছিল। আমি তা উপভোগ করতাম। কর্মজীবনে প্রবেশের পর তিনি (মিজারুল কায়েস) একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার সময় রবীন্দ্রভুবনকে দূর থেকে উঁকি মেরে দেখা ছিল। ’ রাজশাহী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিবিড়ভাবে কৌতূহলী করে তোলে। সে কৌতূলে আমরণ শেষ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অনুরাগ এত গভীর ছিল যে দুই মেয়ের নাম রেখেছিলেন মাধুরী ও মানসী। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ের নাম মাধুরীলতা ও একখানা কাব্যের নাম মানসী।

মিজারুল কায়েসের রবীন্দ্রভুবন উন্মোচনে আমার (সামান্য) সহায়তা ছিল, সে কথা তিনি ভোলেননি। এই তো সেদিন জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ (২০১৭) সে অনুভবের প্রতিধ্বনি শোনা গেল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান (সাবেক মেধাবী বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডার কর্মকর্তা) আমার ভাতিজা, ড. আবুল কাসেম, তাঁর বিভাগে একটি বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। মিজারুল কায়েস ছিলেন একক বক্তা। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে আমি সেখানে উপস্থিত হলে মিজারুল কায়েস দাঁড়িয়ে দুই বাহু ঊর্ধ্বে তুলে আবেগ কম্পিত স্বরে বলে উঠলেন, আমার সাক্ষাৎ শিক্ষক, কবির স্যার, রবীন্দ্রভুবনে প্রবেশের ‘স্বপ্নলোকের চাবি’ স্যারের ক্লাসে বক্তৃতা শুনেই পেয়েছি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী দার্শনিক হাসান আজিজুল হক, মিজারুল কায়েসের সহধর্মিণী, ড. আবুল কাসেম প্রমুখ। তাঁরা সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে আকস্মিক ঘটনাটি উপভোগ করলেন। আমি অভিভূত। শিক্ষকতার এমন হার্দিক স্বীকৃতি কজনের মেলে! বিনা স্বার্থে?

এবার মূল আয়োজন বক্তৃতাপর্ব শুরু হলো। এখানেও প্রথমে আমাকে নিয়ে কয়েকটি বাক্য উচ্চারণের পর ইংরেজিতে বক্তব্য প্রদান করতে করতে একপর্যায়ে বাংলায় ফিরে এলেন, স্বদেশি ভাষায় শ্রোতাদের আশা মেটানোর জন্য। ধীমান মিজারুল কায়েসের সেই অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল, শিক্ষার্থীর গৌরব কিভাবে শিক্ষককে সার্থক করে তোলে। এ অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে তাঁর সতীর্থ ও আমার ছাত্র ড. চৌধুরী সরোয়ার জাহান সজল (এখন প্রোভিসি, রাবি), ড. আব্দুল মজিদ প্রফেসর প্রাণিবিদ্যাও উপস্থিত ছিলেন।

‘বহুমানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা/লক্ষযুগের সংগীত মাখা’ মধুময় পৃথিবীর ধূলির জীবন ও সংস্কৃতির আনাচকানাচে প্রবেশের প্রজ্ঞা অর্জন করেছিলেন মিজারুল কায়েস। সম্প্রতি তিনি রবীন্দ্র চিত্রকলার রেখার মধ্যে নতুন দর্শনের খোঁজে ব্যাপৃত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সৃষ্টি জগেক নিজের দীপ্ত চেতনা দিয়ে বিশ্লেষণ করে শ্রোতাদের ভাবনার রসদ জুগিয়েছেন। কবি ইকবালকে বাংলার আরজ আলী মাতুব্বরের অনুসন্ধিত্সু দর্শনের সঙ্গে মেলানোর পথ দেখিয়েছেন। এত সব বিষয় তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থেকে অবহিত হয়েছি।

পররাষ্ট্রসচিব থাকার সময় ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলের ওপর তাঁর বক্তৃতার আমন্ত্রণ ছিল। সেই বক্তৃতার ছক দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে টেলিফোনে শুনিয়েছিলেন। আমি বিস্মিত-চমত্কৃত হয়েছিলাম তাঁর নতুন আঙ্গিকের বিশ্লেষণ শুনে। মনে ভেবেছিলাম, শিক্ষার্থীর কাছে হার মানার এমন সুখ হয়তো অনেকে পান না।

সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচনের বিপুল সম্ভাবনা অসমাপ্ত রেখে মিজারুল কায়েস অকালে চলে গেলেন (১১ মার্চ ২০১৭) এবং আমাদের বেদনার বহন করতে রেখে গেলেন।

মধুসূদন ৫০ বছর বয়স পার করার আগেই চলে গেলে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, “সুপবন বহিতেছে দেখিয়া, জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও, তাহাতে নাম লেখ ‘শ্রী মধুসূদন’। ”

মিজারুল কায়েসের অকালপ্রয়াণে আমার মতো এক অখ্যাত শিক্ষক একই কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে চায়, বাঙালির মানবমহিমাময় উদার সংস্কৃতির পতাকায় যেন মিজারুল কায়েসের নামটি লেখা থাকে।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004148006439209