শিক্ষক দিবসের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা | মতামত নিউজ

শিক্ষক দিবসের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

গত ২৭ অক্টোবর দেশে গভীর উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো 'শিক্ষক দিবস' উদযাপিত হয়েছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষকের জন্য এটি এক অসাধারণ আনন্দের দিন ছিল। আবেগ ও উচ্ছাসে শিক্ষকেরা দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে করেছেন।

গত ২৭ অক্টোবর দেশে গভীর উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো 'শিক্ষক দিবস' উদযাপিত হয়েছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষকের জন্য এটি এক অসাধারণ আনন্দের দিন ছিল। আবেগ ও উচ্ছাসে শিক্ষকেরা দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে করেছেন। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ফুল দিয়ে সম্মাননা জানিয়েছেন। উপহার দিয়েছেন। অনেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শিক্ষকদের জন্য শুভ কামনা করেছেন। তাঁদের জন্য হৃদয়ের অন্তর্নিহিত ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। পরলোকগত শিক্ষকদের আত্মার শান্তি কামনা করেছেন। জীবিতদের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা করেছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষকেরা আনন্দ-উচ্ছাসে দিবসটি উদযাপন করেছেন। সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে নানা মাধ্যমে স্বদেশে দিনটি উদযাপনের বিভিন্ন চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি। খুব ভালো লেগেছে।

আমার শিক্ষকতা জীবনের সুদীর্ঘ তিনযুগেও এমন একটি দিন আমার নসিবে জুটেনি। জেলা ও উপজেলায় শিক্ষকরা র‌্যালি করেছেন। আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছেন। আজ থেকে কয়েক বছর আগে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রথম যখন ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা পেয়েছিলেন তখন তাদের মধ্যে যে উচ্ছাস দেখা গিয়েছিলো, প্রথম শিক্ষক দিবসে তাঁদের মধ্যে সে রকম আনন্দ-উচ্ছাস দেখেছি। অতিশয় আনন্দ অনুভব করেছি। তবে সত্যি কথা বলতে কি, এদিন সরকারি শিক্ষকদের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের বেশি আনন্দ-উচ্ছাস করতে দেখেছি। এর কারণ, এই দিনকে কেন্দ্র করে তাঁরা তাঁদের অভাব-অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের কানে পৌঁছানোর একটি সুযোগ দেখতে পেয়েছেন। নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখ ভাগ করে এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখেছেন। দিনটিতে আমি আমার সর্বস্তরের শিক্ষকদের জন্য শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। আমার শিক্ষক হওয়ার পেছনে যাদের অনুপ্রেরণা ছিল, তাঁদের কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করেছি। যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করে জীবন ও যৌবনের সোনালী সময় পার করে এসেছি, তাদের মনেপ্রাণে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। পরলোকগত শিক্ষকদের আত্মার শান্তি কামনা করেছি। জীবিতদের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করেছি।

জানিনা দিনটিকে কে, কোন দৃষ্টিতে দেখেছেন?  আমি অন্তত বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের জন্য এটিকে একটি তাৎপর্য্যময় অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে দেখছি। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অধিকার আদায়ের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের আত্মমর্যাদা কিছুটা হলেও বেড়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুমধুর সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার অবকাশ তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা যখন চরম অবহেলা এবং আর্থিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মর্যাদার এক রকম তলানিতে পৌঁছে গেছেন, ঠিক তখন শিক্ষক দিবস কিছুটা হলেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। জানিনা আমাদের দেশে প্রতি বছর দিনটি 'শিক্ষক দিবস' হিসেবে পালন করা হবে কি-না ? বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকারের স্পষ্ট করা উচিত। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উদ্যোগে দিবসটি উদযাপিত হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে দিবসটি উদযাপন সংক্রান্ত একটি চিঠি পড়েছি। তাতে ফি বছর দিবসটি উদযাপনের কোন কোন ইঙ্গিত নেই। আমার মনে হয় এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট সার্কুলার প্রয়োজন। প্রতি বছর জাতীয়ভাবে দিনটি উদযাপন করা উচিত। দিবসটি কেবল 'শিক্ষক দিবস' না হয়ে 'জাতীয় শিক্ষক দিবস' হলে আরও ভালো হয়।

গত ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়কে ২৭ অক্টোবর শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়। প্রতিপাদ্য বিষয়টি চমৎকার এবং জুতসই বটে। কিন্তু ভিন্ন আরেকটি প্রতিপাদ্য বিষয় দেয়া যেতো। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ও শিক্ষকদের কেন্দ্র করে একটি পৃথক প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা যেত। আমার কেন জানি মনে হয, ৫ অক্টোবরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসটি ২৭ অক্টোবর বকেয়া হিসেবে উদযাপন করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি সাহেবের বক্তব্যে এমন ইঙ্গিত মেলে। তিনি বলেছেন, ৫ অক্টোবর দূর্গাপূজার ছুটি থাকায় বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপিত হয়নি। তাই ২৭ অক্টোবর দেশে শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ থেকে কী বুঝা যায় ? শিক্ষক সমাজকে বোকা বানানোর কোনো প্রয়াস নয় তো? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই শিক্ষক দিবসের বাইরে রাখা হয়েছিলো বলে মনে হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর দিবসটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বা সরকার থেকে সিদ্ধান্ত নিলে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষকরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারতেন এবং দিবসটি সত্যিকারের অনন্য মর্যাদা অর্জন করতে পারতো।

আমাদের দেশে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষক দিবস পালনের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে। বছরে তিনশ' পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে অন্তত একটি দিন শিক্ষকদের জন্য উৎসর্গ করতে হবে। শিক্ষা ও শিক্ষকের দুর্দশা ও দূর্গতি বছরে একটি দিন হলেও পর্যালোচনার সুযোগ থাকলে ভালো হয়। অবসরপ্রাপ্ত ও প্রবীণ শিক্ষকদের খোঁজ খবর নেয়ার একটা সুযোগ থাকা চাই। শিক্ষার হাল এবং শিক্ষকের অবস্থান জানার ও বুঝার একটা মাধ্যম থাকা প্রয়োজন। তা না হলে শিক্ষকেরা অবহেলা ও অমর্যাদায় একদিন হেরে যাবেন এবং শিক্ষা তার নিজ অক্ষ পথটি হারিয়ে ফেলবে। আমাদের দেশে আজ অনেকটা তা-ই হতে চলেছে। সদ্য গত বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় 'শিক্ষকদের হাত ধরে শিক্ষা ব্যবস্থার রুপান্তর শুরু' যা আমাদের শিক্ষক দিবসেও প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। শিক্ষা নদীর স্রোতের মত বহমান একটি প্রক্রিয়া। এটি কোন স্থির বস্তু বা বিষয় নয়। মানবজীবনের ধাপে ধাপে শিক্ষার রূপান্তর এক অপরিহার্য বিষয়। মানবজীবনের মতোই শিক্ষা ব্যবস্থা এক পরিবর্তনশীল জীবনাচরণ। এই পরিবর্তন বা রূপান্তর কেবল শিক্ষকের হাতেই সম্ভব। অন্য কারো হাতে এই রুপান্তর বা পরিবর্তন অসম্ভব। তাই শিক্ষার পরিবর্তন তথা প্রবাহ টিকিয়ে রাখতে শিক্ষককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মানবসভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও রূপান্তর যেমন অপরিহার্য, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার যথার্থ রূপান্তর করতে উত্তম শিক্ষকের বিকল্প কিছু নেই।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষক সমাজের দিকে তাকালে কী দেখতে পাই ? আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন চরম অবহেলার শিকার, তেমনি শিক্ষক সমাজের দুর্দশা ও দূর্গতির অন্ত নেই। শিক্ষকদের যথাযথ মুল্যায়ন নেই বলে আমাদের দেশে শিক্ষার প্রকৃত রূপান্তর হচ্ছেনা। শিক্ষার প্রকৃত রূপান্তর নেই বলে মানসম্মত শিক্ষা থেকে নতুন প্রজন্ম বঞ্চিত। মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষক দরকার। মানসম্মত শিক্ষক আমরা কোথায় পাবো? যেখানে এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর পাঁচশত টাকা চিকিৎসা ভাতা, সেখানে কোন খায়েশে একজন মেধাবী লোক শিক্ষকতায় আসবে? বাড়ি থেকে পাঁচশ' বা হাজার মাইল দূরে শিক্ষকতা করতে গিয়ে এক হাজার টাকায় কি ঘর মিলবে? আজকাল পাঁচশ' টাকায় কোনো ডাক্তার রোগী দেখে  সেক্সপিয়র না অন্য কে যেন তার এক শিক্ষক বন্ধুকে একদা ঠাট্টা করে বলেছিলেন, 'One who can does, who can't teaches'. (যে পারে সে কিছু একটা করে, আর যে কিছু পারেনা সে শিক্ষকতা করতে আসে।) আমাদের দেশে যেন আজ তা-ই হতে চলেছে। কেউ পারত পক্ষে আজ আর শিক্ষকতায় আসতে চায়না। পরীক্ষার খাতায় জীবনের লক্ষ্য লিখতে গিয়ে শিক্ষকের সন্তানেরাও শিক্ষক হওয়ার কথা লেখেনা। সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ অফিসার কিংবা ব্যবসায়ী হওয়ার কথা লেখে। কেউ যদি শিক্ষক হতে না চায়, তাহলে কার হাতে শিক্ষার রুপান্তর হবে?  আমাদের শিক্ষাকে কে বাঁচাবে?  শিক্ষার রুপান্তর না হলে এমনিতে শিক্ষা একদিন মরে যাবো। আর সেদিন আমরা এক মৃত জাতি বলে ইতিহাসে চিহ্নিত হবো। শিক্ষাবিহীন অনেক জাতি এর আগেও পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এ বিষয়টি চরমভাবে উপলব্ধির সময় হয়েছে। শিক্ষক দিবসে এ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কেবল ঢোল-তবলা বাজিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রা করে শিক্ষক দিবস উদযাপন করে কোন লাভ নেই। শিক্ষক সমাজকে সর্বাগ্রে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের কষ্টকথা ও শিক্ষার দূর্দশা জাতিকে অবহিত করতে হবে। তা না হলে সরকার কিংবা অন্য কেউ উপযাচক হয়ে শিক্ষা ও শিক্ষকের জন্য কিছু করতে আসবে বলে মনে হয়না।  

লেখক  : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দৈনিক শিক্ষা ও আমাদের বার্তার আবাসিক সম্পাদক।