সুপারভাইজারদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শিক্ষকদের অনীহার নেপথ্যে | শিক্ষাবিদের কলাম নিউজ

সুপারভাইজারদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শিক্ষকদের অনীহার নেপথ্যে

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষক হচ্ছেন উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজাররা। এরই মধ্যে ৩৩০ জন সুপারভাইজার প্রথম ধাপের প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। তবে নতুন কারিকুলামে তাদের প্রশিক্ষক ভাবতে নারাজ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সম্প্রতি দৈনিক আমাদের বার্তার প্রতিবেদন

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষক হচ্ছেন উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজাররা। এরই মধ্যে ৩৩০ জন সুপারভাইজার প্রথম ধাপের প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। তবে নতুন কারিকুলামে তাদের প্রশিক্ষক ভাবতে নারাজ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সম্প্রতি দৈনিক আমাদের বার্তার প্রতিবেদনে দেখলাম, তারা বলছেন একাডেমিক সুপারভাইজাররা শিক্ষক নন, তাই অশিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেবেন না। তারা প্রশিক্ষক পদে একাডেমিক সুপারভাইজারদের নির্বাচন বাতিল দাবি করেছেন। শিক্ষকদের কেউ কেউ এমনও বলছেন, সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষক বানিয়ে শিক্ষা প্রশাসনে সরকারি স্কুল শিক্ষকদের অপমান করা হয়েছে। সরকারি স্কুল শিক্ষকদের এ অবস্থানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন একাডেমিক সুপারভাইজাররা। তাদের সংগঠন সেসিপ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের নেতারা বলছেন, পাঠদান তদারকিতে নিয়োজিত সুপারভাইজরারা প্রশিক্ষিত মাস্টার ট্রেইনার। সরকারি স্কুলের কেউ কেউ এতে বিরোধিতা করছেন।

নতুন শিক্ষাক্রমের বিস্তরণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শিগগিরই শুরু হচ্ছে। এজন্য শুরু হয়েছে জেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। প্রথম ব্যাচে গত ৯ আক্টোবর থেকে ১৫ আক্টোবর পর্যন্ত ৩৩০ জন একাডেমিক সুপারভাইজার ও ১৫৪ জন শিক্ষা কর্মকর্তা নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ উদ্যোগের বিরোধিতা করে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির খুলনা অঞ্চলের সভাপতি বলেন, শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিপুল সংখ্যক অশিক্ষক একাডেমিক সুপারভাইজার নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকদের অসম্মান ও অপমান করা হয়েছে। প্রকল্প থেকে আসা সুপারভাইজারদের দিয়ে সরকারি বেসরকারি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ। আমরা একাডেমিক সুপারভাইজারদের কাছে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নেবো না। অশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ থেকে বাদ দেয়া না হলে আমরা প্রশিক্ষণ বর্জন করবো। কিন্তু আমরা জানি, একাডেমিক সুপারভাইজাররা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং সারা দেশের একাডেমিক কাজ বর্তমানে তারাই তদারকি করছেন। তাদের নিয়োগকালীন যোগ্যতা ছিলো বিএডসহ কিংবা এমএডসহ  স্নাতকোত্তর। এরপর প্রায় সবাই পাঠদান সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ বিদেশেও প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

এখানে অনেক বিষয় জড়িত। একটি হচ্ছে একজন শিক্ষক তিনি সরকারি অথবা বেসরকারি হোন তিনি শিক্ষকই। তার ধ্যান-জ্ঞান হবে শেখা ও শেখানো। শেখার বিষয়টি আমরা শুধু আমার চেয়ে র‌্যাংকে ওপরে তার কাছ থেকেই শিখতে পারব তা কিন্তু নয়। আমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। প্রতিদিন, প্রতিনিয়তই গ্রহণ করি। আপনি বিভিন্ন জায়গায় চুল কাটাতে যাবেন দেখবেন কোনো কোনো দোকানের ব্যবহার আপনাকে মুগ্ধ করবে, আবার কারোর আচরণ ব্যবসায়ীর ধারে কাছেও নেই। আর বর্তমান কারিকুলামে এ ধরনের বিষয়ও জড়িত। সেনাবাহিনীতে যারা শিক্ষা কোর, মেডিক্যাল কোর, ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসাররা তারা কিন্তু মাস্টার্স পাস, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর সেনাবাহিনীতে ঢোকেন। তাদের মিলিটারি ট্রেনিংয়ের একটি বড় অংশ পরিচালনা করেন হাবিলদার, যারা সাধারণত এসএসসি পাস। তিনি কিন্তু এসব সদস্যদের কঠোর প্রশিক্ষণ দেন এবং শাস্তিও দিয়ে থাকেন। এখন মাস্টার্স পাস করা সদস্যরা, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়াররা যদি মনে করেন আমরা হাবিলদারের কাছে থেকে কেনো প্রশিক্ষণ নেবো, আমরা তো সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং কয়েক মাস পরেই ক্যাপ্টেন হবো। তা কিন্তু তারা করেন না। কারণ, হাবিলদার যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তা তাদের বাস্তব জীবনে অনেক কাজে লাগে। যে প্রশিক্ষণ একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিংবা মেজর জেনারেল দিতে পারবেন না। তা ছাড়া প্রশিক্ষণকালীন তাদের এ ধরনের আচরণ জীবনের একটি বড় শিক্ষা। আমি দেখেছি ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করা অনেক তুখোড় ছেলেমেয়ে মিলিটারি একাডেমিতে হবিলদারের চাপে অস্থির। জীবনের এটাও একটি বিরাট শিক্ষা। মিলিটারী একাডেমি পরিদর্শনের সময় বার বার দেখেছি কত কঠিন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন সেই হাবিলদাররা। যাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তারা হতে যাচ্ছেন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। অনেকেই যার এন্ট্রি লেভেলে নয় ক্যাপ্টেন হবেন অর্থাৎ একজন এডিসি র‌্যাঙ্কের কর্মকর্তা। তাকেও কিন্তু প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন সেই হাবিলদার।  

দ্বিতীয় যে বিষয়টি মনে আসে তা হচ্ছে শিক্ষকদের মধ্যে এতো বিভক্তি, প্রটোকল নিয়ে এতো চিন্তা এতো ভাবনা! আসল কাজ বাদ দিয়ে শুধু প্রটোকলের চিন্তা? সরকারি কলেজ শিক্ষক যারা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে এসেছেন তারা মনে করেন যারা আত্তীকৃত শিক্ষক তারা কলেজে থাকা এক ধরনের অপমান! অথচ সেরা কলেজগুলোই সরকারিকরণ হয় এবং যার ফলে সরকারি কলেজের সংখ্যা এবং সরকারি কলেজের পদ বৃদ্ধি পেতে পেতে ১৬ হাজার হয়েছে। আবার এই শিক্ষা ক্যাডাররাই তিলে তিলে গড়ে ওঠা বেসরকারি কলেজগুলোতে প্রেষণে অথবা লিয়েনে অধ্যক্ষ হতে মরিয়া। 

আবার কলেজ শিক্ষকরা স্কুলের শিক্ষকদের মনে করেন তারা তো নিজেরা কিছু জানেন না আবার শিক্ষার্থীদেরকেও সেভাবে পড়ান না। তাই কলেজে আমরা যাদেরকে পাই তারা অত্যন্ত দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলেন, কলেজ শিক্ষকরা কিছুই পড়ান না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী তারা পাঠিয়ে থাকেন তারা খুবই দুর্বল। আবার ব্যতিক্রম ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কলেজ, মাধ্যমিক পর্যায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কি পড়ানো হয় এগুলো জানা বা জানতে চাওয়া এক ধরনের প্রেস্টিজ মনে করেন। তারা বলেন এবং মনে করেন, আমরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে ডিল করি, নিচের দিকে এসব কী হয় এগুলো তো স্কুলের শিক্ষকদের ব্যাপার, আমরা জানতে যাব কেনো?  

তারা ওগুলো না জানাটাই ক্রেডিট মনে করেন। অথচ একজন শিক্ষককে কিন্তু শিক্ষার সব স্তরের খোঁজখবর রাখা প্রয়োজন। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক নিয়ে কিছু আলোচনা ও কিছু অবাক করা প্রশ্ন শুনলে অবাক হওয়ার চেয়েও বেশি কিছু মনে হয়। তারা মনে করেন, তারা যে বিষয়ের একটি বা দুটি অধ্যায় পড়াচ্ছেন ওটাই যথেষ্ট। নিচের দিকের পড়াশুনার বিষয় জানা তাদের কাছে অপমানজনক বিষয়। কিন্তু সমাজের অদ্ভুত  নিয়ম এসব শিক্ষকদেরকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক বড় বড় গবেষণা করতে দেয়া হয়, মূলত গবেষণা তো নয়, অর্থ চালাচালি। যে বিষয়ের ওপর তাদের কোনো প্রজেক্ট করতে দেয়া হয় সেই বিষয়ে হয়তো জীবনে প্রথমবার খোঁজখবর নিয়ে জেনেছেন। আবার জাতীয় কোনো সিদ্ধান্তেও দেখেছি তাদের ডাকা হয় অথচ প্রথমবারই হয়তো ওই বিষয়টি তিনি শুনেছেন, তখন মনগড়া কিছু কথা বলে চলে আসেন। 

সরকারি স্কুলের শিক্ষক হলে অনেকে মনে করেন আমরা বাদে অন্যরা কেউ কিছু জানেন না। আসলে আমাদের দেশের চাকরির জন্য যেসব নির্বাচনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, তা কতোটা মানসম্মত, কতোটা আন্তর্জাতিক মানের সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। নতুন কারিকুলামে প্রথমবার প্রশিক্ষণে তো, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের টিচার, সরকারি স্কুলের টিচাররা ছিলেন। তাতে কি খুব বেশি কিছু হয়েছে? বহু শিক্ষক আজও নতুন কারিকুলামের অনেক বিষয়ইে খুব স্পষ্ট ধারণা নিতে পারেননি। আর ওই সরকারি বা টিটি কলেজের টিচারদের অনেকে প্রশ্নই করেননি। অনেকে করেও সঠিক উত্তর পাননি। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা যদি মনে করেন যে, তারা যা পড়াচ্ছেন সে রকম আর কেউ পড়াতে পারেন না। সে রকম উদহারণ কি আমাদের দেশে আছে? আমরা দেখি ঢাকাসহ অনেক ছোটবড় শহরে কিছু ছেলেমেয়ে/শিক্ষার্থী/বেকার ছেলেমেয়ে শুধু টিউশনি করে চলেন। তারা দেখা যায়, অনেক শিক্ষকের চেয়ে অনেক ভালো পড়াতে পারেন, বোঝাতে পারেন। সরকারি স্কুলের বা কলেজে শিক্ষকরা এমন কিছু অবিষ্কার করেছেন যা শিক্ষায় কোনো ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে? বা অন্য কেউ এটি পারবে না? একটি বিষয় বছরের পর বছর পড়াচ্ছেন, সেখানে নতুনত্ব বা ক্রিয়েটিভির কোনো বিষয় নেই। তাহলে আপনি যা পড়াচ্ছেন বা যে লেভেলে বা বিষয়ে পড়াচ্ছেন সেটা অন্য কেউ বিশেষ করে একাডেমিক সুপারভাইজররা পারবেন না কেনো? তারা সেসিপ প্রজেক্টের সব প্রশিক্ষণ করিয়েছেন। প্রধান শিক্ষকদের কারিকুলামের ওপর প্রশিক্ষণ করিয়েছেন। উপজেলায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কিন্তু তারাই করিয়ে থাকেন। একাডেমিক সুপারভাইজারদের একটি বড় অংশ কিন্তু সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। 

ব্র্যাকে একটি প্রশিক্ষণ বিভাগ আছে, সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক প্রশিক্ষক রয়েছেন কিন্তু তারা কেউই শিক্ষক নন। অথচ তারা ডাক্তারদের, প্রশাসকদের, প্রধান শিক্ষকদের, বিষয় শিক্ষকদের ছাড়াও বিভিন্ন পেশার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। বিদেশি প্রশাসকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ভাগ্যিস, তাদের কোনো সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়নি। তাহলে তারা হয়তো বলেই বসতেন, আমরা অশিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেবো না। আমাদের শিক্ষক সমাজকে অনেক বদলাতে হবে। আমি না বদলালে কিন্তু শিক্ষা বদলাবে না, দেশ বদলাবে না। গাড়ির হেলপার থেকে যার পাঁচ দশটি গাড়ির মালিক হন তাদেরকে স্যালুট জানাতে আমাদের সমাজ জানে না। রাস্তার পাশের ছোট দেকানদার থেকে যারা কোটিপতি ব্যবসায়ী হন, স্যালুট তাদেরকেও। আমরা কি একবারও চিন্তা করে দেখেছি যারা অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে একটি চাকরি খুঁজছেন বা একটি চাকরি করছেন, অথচ রাস্তার পাশের ছোট একজন দোকানদার নিজের চেষ্টায় ও বুদ্ধি খাটিয়ে বড় দোকানের মালিক হয়েছেন, ইন্ডাসট্রির মালিক হয়েছেন, শত শত হাজার হাজার লোক তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ধারে কাছেও  যেতে পারেননি, কিংবা গেলেও খুব একটা আগাতে পারেননি। কিন্তু দেশ ও মানবতার প্রতি কার অবদান কতো বেশি? কার কাছে আমরা অর্থনীতি শিখতে যাবো? ওই ছোট থেকে নিজ চেষ্টায় ও বুদ্ধি খাটিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তার কাছে অর্থনীতি শিখবো না অর্থনীতিতে  পিএইচডি নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠা কেরানিগিরি করছেন তার কাছ থেকে অর্থনীতি শিখবো? প্রকৃত অর্থনীতি কিন্তু আমরা শিখতে পারি ওই ছোট থেকে বড় হওয়া দোকানির কাছে থেকেই। আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে, শিক্ষকদের বদলাতে হবে অনেক বেশি। নতুন কারিকুলামে কিন্তু এসব বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষয়গুলো কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে। 

লেখক: প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সাবেক শিক্ষক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ। 

সুপারভাইজারদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শিক্ষকদের অনীহার নেপথ্যে