শিক্ষাকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি | শিক্ষাবিদের কলাম নিউজ

শিক্ষাকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি

আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন, সুপার নিউমারারি পদে পদোন্নতি, অধ্যাপক পদ তৃতীয় গ্রেডে উন্নীতকরণসহ বিভিন্ন দাবিতে দ্বিতীয়বারের মতো ১০ অক্টোবর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি কর্মবিরতি পালন করে। এ কর্মসূচির ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রশাসন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। শিক্ষা প্রশাসনের কেন্দ্র মাধ

আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন, সুপার নিউমারারি পদে পদোন্নতি, অধ্যাপক পদ তৃতীয় গ্রেডে উন্নীতকরণসহ বিভিন্ন দাবিতে দ্বিতীয়বারের মতো ১০ অক্টোবর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি কর্মবিরতি পালন করে। এ কর্মসূচির ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রশাসন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। শিক্ষা প্রশাসনের কেন্দ্র মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ডগুলো, এনসিটিবি, নায়েম ডিআইএসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। তাদের কর্মবিরতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রশাসনে স্বাভাবিক কাজ চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনিতেই শিক্ষা বিভাগের সব কাজই অন্যান্য সব বিভাগের থেকে পিছিয়ে থাকে। মাউশি বা মন্ত্রণালয়ে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষক কর্মচারীরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও কাঙ্ক্ষিত কর্মকর্তার দেখা পান না। তারা মন্ত্রণালয়, মন্ত্রীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদানে ব্যস্ত থাকেন। বরগুনা, কুড়িগ্রাম আর দিনাজপুরের মতো দূরবর্তী জেলাগুলো থেকে শিক্ষকরা কাজ না হওয়ায় অনেক সময় খালি হাতে ফেরত যান। তার মধ্যে আবার এই কর্মবিরতি। এ যেনো ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা ক্যাডারদের দ্বারা পরিচালিত বলে এখানে কিন্তু সেবার মানের কোনো উন্নতি হয়নি, সেবা নিতে আসা শিক্ষকদের জন্য কোনো কিছু আগের চেয়ে সহজ করা হয়নি। এখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা থাকলে আমরা সে কথা সহজেই বলতাম। কিন্তু শিক্ষকরাই কিন্ত এখানে সবকিছ করছেন, কিন্তু সেবার মান কখনো বাড়েনি।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, রাজধানী ঢাকার শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার দপ্তরগুলো ও সরকারি কলেজগুলোসহ সারা দেশের সরকারি কলেজগুলোতে এ কর্মসূচি চলেছে। পরীক্ষাও পেছানো হয়েছিলো। এ সময় দপ্তরগুলোতে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা কোনো ফাইলে সই করেননি। ফলে সরকারি কলেজসহ শিক্ষার দপ্তরগুলো অচল ছিলো। ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের সকল সরকারি কলেজ, আলিয়া মাদরাসা, সরকারি টিটি কলেজ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, পরিদর্শণ ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা পালন করেছেন সর্বাত্মক কর্মবিরতি। ক্লাস, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা, শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীন ভর্তি, ফরম পূরণ, সকল ধরনের পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা এবং দাপ্তরিক সব কর্মকাণ্ড কর্মবিরতির আওতায় ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ১৭ ও ১৯ অক্টোবর আবার সর্বাত্মক কর্মবিরতি ঘোষণা করেছেন তারা।  

শিক্ষার্থীরা তো এমনিতেই ক্লাসে আসতে চান না, ক্লাসে আসলেও পড়াশোনায় মনোযোগ দেন না। পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে চান না। তাদের পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। এটাতো তাদের জন্য পোয়াবারো। কিন্তু দেশের শিক্ষার যে হাল হয়েছে তার কী হবে? কে বা কারা এজন্য দায়ী? সেদিন একজন কলেজ অধ্যক্ষ বললেন, শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে সেটি কাটিয়ে উঠতে একশত বছর লেগে যেতে পারে। কতো গভীর উপলব্ধি! আসলেও বাস্তব কথা। কোথায় নিয়ে গেছি আমরা শিক্ষাকে। আমরা ধরে নিচ্ছি শিক্ষকরা আছেন, নিয়োগ হচ্ছে, পরীক্ষা হচ্ছে, বোর্ড ফল ঘোষণা করছে সবই তো ঠিক আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নতুন কারিকুলাম আসছে, শিক্ষার্থীরা আনন্দের মাধ্যমে শিখছেন। আসলে যে কী হচ্ছে তা কিন্তু প্রকৃত অর্থে কেউ ভেবে দেখছি না, জানি না, জানার চেষ্টাও করি না। পড়াশোনা করছে না শিক্ষার্থীরা, পড়াচ্ছেন না শিক্ষকরা, হচ্ছে না মূল্যায়ন। পরীক্ষায় বসলে নকল করে লেখা, বাধা দিলে শিক্ষককে শারীরিক আক্রমণ। কদিন আগেও চূয়াডাঙ্গায় দশম শ্রেণির সরকারি স্কুলের এক ছাত্র পেছনের খাতা দেখে লেখায় তার খাতা নিয়ে যান শিক্ষক। অতপর শিক্ষককে চড় থাপ্পড় মেরেছেন শিক্ষার্থী। কলেজের শিক্ষার্থীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ কাজে দক্ষ। স্কুল শিক্ষার্থী ভাবলেন বড় ভাইয়েরা এগুলো করে আরো ওপরে উঠে যাচ্ছেন, তাদের সবকিছু হচ্ছে তো আমরা স্কুলের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকব কেনো! পরীক্ষার হলে সকলের সামনে শিক্ষককে চড় মেরে বড় ভাই হতে চেয়েছিলেন। এই ধরনের শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে সমাজে! এটি একজন শিক্ষককে চড় মারা নয়, গোটা শিক্ষক সমাজকে, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে চড় মারা। ভাগ্যিস ছেলেটি কোনো রাজনৈতিক পরিবারের নয়। তাহলে শিক্ষককেই হয়তো এতোক্ষণে জেলে যেতে হতো। 

ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন, সুপার নিউমারারি পদে পদোন্নতি, অধ্যাপক পদ তৃতীয় গ্রেডে উন্নীতকরণ, অর্জিত ছুটি দেয়া ও আনুপাতিক হারে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডসহ প্রয়োজনীয় পদসৃজন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাদরাসা শিক্ষা অধিদপত্রসহ বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের জন্য বিসিসএস সাধারণ শিক্ষা কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুলস ১৯৮০ পরিপন্থি সকল নিয়োগবিধি বাতিল, শিক্ষা ক্যাডার তফসিলভুক্ত পদ থেকে শিক্ষা ক্যাডার বহির্ভূতদের প্রত্যাহার, জেলা-উপজেলায় শিক্ষা ক্যাডার পরিচালিত শিক্ষা প্রশাসন সৃষ্টি ও চাকরির ৫ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দিতে হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, বঞ্চনা আর বৈষম্যের মাধ্যমে এই পেশার গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে চতুর্থ গ্রেডের ওপর কোনো পদে নেই। শিক্ষা ক্যাডারে সর্বোচ্চ অধ্যাপক পদটি চতুর্থ গ্রেড হওয়ায় পঞ্চম গ্রেড হতে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতির সুযোগ নেই। তাই অধ্যাপক পদটি তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত করা এবং আনুপাতিক হারে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের পদ তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তারা আরো বলছেন, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে নতুন পে-স্কেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডাররা। তাদের পূর্ণ গড় বেতনে অর্জিত ছুটির বিষয়ে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্মতি প্রদান করলেও প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবে এটি আলোর মুখ দেখেনি। তাই সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারদের দাবি আদায়ে জরুরিভাবে একটি দক্ষ, যুগোপযোগী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন সময়ের দাবি। 

শিক্ষা ক্যাডারের সব দাবিই যৌক্তিক। রাষ্ট্রকে এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে যদি শিক্ষাকে আমরা মূল্যায়ন করতে চাই, দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সঠিকভাবে তৈরি করতে চাই। আবার শিক্ষকদেরকেও অন্যান্য সব পেশার মতো হলে চলবে না। শিক্ষার যে করুণ দশা তার জন্য আমরা সবাই কম-বেশি দায়ী। শুধুমাত্র রাষ্ট্রের ওপর দায় চাপালে হবে না। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দায়-দায়িত্ব বেশি বহন করতে হবে। রাষ্ট্রকে যে বিষয়টি দেখা দরকার সেটি হচ্ছে গণ-পদোন্নতির বিষয়টি পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা। পদ নেই তারপরেও গণ-পদোন্নতি। প্রয়োজন নেই অথচ গণহারে পদোন্নতি। এতো পদোন্নতিার ব্যয়ভার কে বহন করবে? আমাদের এই দরিদ্র দেশ কি তা বহন করতে পারে? পারে না। শুধুমাত্র সাধারণ জনগনকে ঠকানো হচ্ছে। তাদের ন্যায় পাওনা রাষ্ট্র দিতে পারছে না অথচ তাদের সেবা করার জন্য যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুযোগের অভাব নেই। এ কেমন খেলা! 

দেখা যায় একজন উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন, তার কাজও বাড়েনি, তার চেয়ারও পরিবর্তন হয়নি। তো এ ধরনের পদোন্নতি দিয়ে কার কতোটা লাভ হয়? একইভাবে অধ্যাপকের অভাব নেই। যদিও অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতির চেয়ে শিক্ষকদের সেভাবে গণহারে দেয়া হয়নি। তারপরেও একজন অধ্যাপক হতে হলে আন্তর্জাতিক মানের হওয়া প্রয়োজন। এখানে কম্প্রেমাইজ করার জায়গা নেই। এটি শিক্ষা। এখানে মানুষ তৈরির কাগিগরদের নিয়ে কথা। একজন অধ্যাপক দেখলে যেন মনে হয়, তিনি আসলেই সবার থেকে আলাদা। তিনি একজন জ্ঞানের আধার। তার সবকিছুতে সে বিষয়গুলো প্রকাশিত হবে। সমাজ যেন তাদের ওপর নির্ভর করতে পারে। তারা যেন সামান্য লোভের কাছে মাথা নত না করে। সামান্য পজিশনের জন্য তারা যেন সবকিছু বিকিয়ে না দেন। পুরো সমাজ এবং পুরো রাষ্ট্র যেন এত অধঃপতনের মধ্যেও ভাবে তিনি একজন অধ্যাপক, তিনি আসলেই সবার থেকে আলাদা। শিক্ষা ক্যাডারদের উচিত এ ধরনের অ্যধাপক। শিক্ষা ক্যাডারদের দরকার প্রকৃত সম্মান।

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, দৈনিক শিক্ষাডটকম

শিক্ষাকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি