শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা সময়ের দাবি - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা সময়ের দাবি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একটি জাতির পরিচয় তার শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের ওপর। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে যে জাতি যত এগিয়ে যাবে, সে দেশ বা জাতি তত উন্নত হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের সর্বপ্রথম ধাপ শিক্ষা। মানবসম্পদের দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশের থেকে বাংলাদেশ অনেক বেশি এগিয়ে। কাজেই মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার গুরুত্বটাও এখানে বেশি দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড-এটি আমরা সবাই জানি; কিন্তু আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার দায়িত্ব যারা কাঁধে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই সে দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন তো করছেনই না; বরং শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সোমবার (১ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায় দেশ, জাতি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রসাতলে যাক, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। এ ছাড়া আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বিরাট বৈষম্যপূর্ণ শ্রেণিবিন্যাস। সন্তানরা জীবনের শুরুতেই একটি বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষা কাঠামোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, বেড়ে উঠছে। অথচ আমাদের সংবিধানে ১৭নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে মূলত তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা। সাধারণত নিু-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা সাধারণ শিক্ষা, বিত্তবানদের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে এবং গরিব ঘরের সন্তানরা মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণ করছে। ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষায় বাংলাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও মানবিক মূল্যবোধের অভাব দেখা যায়। এ দুই মাধ্যমের শিক্ষার ধারাটাই ভিন্ন, যা আমাদের সংবিধান পরিপন্থি। তারপরও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা সময়ের দাবি। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গোড়ায় গলদ। যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, গবেষণা করেন, তারা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন জানি না; কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ দিব্যদৃষ্টিতে যা দেখছি, তাতে করে মনে হয়-বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে চলছে, যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সেটি ভেবে শঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষকতার মতো একটা পবিত্র ও মহান পেশা কোথায় নেমে যাচ্ছে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।

শিক্ষা খাতের দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত তথ্য প্রতিনিয়ত প্রচার হচ্ছে; কিন্তু এর প্রতিকার খুব একটা দেখা যায় না। অতি সম্প্রতি এ খাতের ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশনের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। নতুন পাঠ্যবই মুদ্রণ, বিভিন্ন ধরনের পূর্ত নির্মাণকাজ, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট-গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষক বদলি ও পদায়ন, নিয়োগ বাণিজ্য, প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার, অপ্রয়েজনীয় বিদেশ ভ্রমণ, প্রশিক্ষণের নামে অর্থ ব্যয়, টেন্ডার বাণিজ্য ইত্যাদি। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক ৩৯টি সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশ সরকার আমলে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কিছুটা হলেও এ খাতের অব্যবস্থা দূর হতে পারে। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কীর্তিকাহিনির কথা গণমাধ্যমের কল্যাণে সবাই জানতে পেরেছে। প্রাইমারি থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে দুর্নীতির মচ্ছব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যেসব শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের কাছে আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য আমাদের সন্তানদের পাঠাচ্ছি। এসব শিক্ষকের কাছে আমাদের সন্তানরা কী শিখবে? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত করে দুর্নীতি ও অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না।

মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবতা, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ গড়ে উঠছে না। শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্টের জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলছে এ কোচিং সেন্টার থেকে সে কোচিং সেন্টারে। অভিভাবকরাও চান একটা ভালো রেজাল্টের সার্টিফিকেট। নীতি-নৈতিকতা এখানে মূল্যহীন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র চড়া দামে হলেও কিনে নিয়ে সন্তানের হাতে তুলে দিতে ছুটছেন।

সর্বত্র চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। মানহীন, সার্টিফিকেটসর্বস্ব লেখাপড়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জীবনের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা নীতি-নৈতিকতাহীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এসব শিক্ষার্থী শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করবে, শিক্ষকের গালে চড় মারবে, গলায় জুতার মালা পরাবে-এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ আমরা জেনে এসেছি, বাবা-মায়ের পরেই শিক্ষকের স্থান। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। জ্ঞানের পাদপ্রদীপ। কিন্তু কতিপয় দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের জন্য এবং মানহীন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য পুরো শিক্ষকসমাজ ছাত্রদের কাছে প্রতিনিয়ত অপদস্থ, অপমানিত এবং লাঞ্ছিত হচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার চেয়ে ব্যস্ত থাকছেন নীতি-নৈতিকতাবর্জিত অর্থহীন কাজের সঙ্গে। শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরিতে বসে জ্ঞানচর্চা করার কথা, কিন্তু লাইব্রেরি এখন জনশূন্য। এখানে জ্ঞানচর্চা করতে আগ্রহীর সংখ্যা কমে আসছে। মেধাশূন্য জাতি দিয়ে পরিবার, সমাজ তথা জাতি চলবে কী করে? মেধাবীরা উন্নত, সচ্ছল জীবনের আশায় দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিত্তবানরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বিত্তবান অভিভাবকদের অবৈধ অর্থ সন্তানদের বেপরোয়া করে তুলছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষার দিকে অনেক বেশি জোর দিতে হবে। উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা অনুকরণ করতে পারি। উত্তর ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম সেরা। এখানে শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক পেশা হিসাবে ধরা হয়। এ দেশের সরকার শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। এখানে বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করা হয় দেশের সংবিধান অনুযায়ী। ৭ বছর বয়সের আগে শিশুদের স্কুলে যেতে হয় না। খেলার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। দৈনিক দুটির বেশি বিষয় পড়ানো হয় না। মাধ্যমিক শিক্ষার শেষদিকে মাত্র একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। এজন্য সরকার ভর্তুকি দেয়। মেধা তালিকায় ১ থেকে ১০ জনের মধ্যে যারা থাকেন, তাদের শিক্ষক হিসাবে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাদের দেশে সবকিছুই এর উলটো। আমরা কি কিছুটা হলেও এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নৈতিক স্খলন রোধ করতে পারি না?

লেখক : মনজু আরা বেগম, সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037918090820312