শিক্ষাব্যবস্থা ঘিরে দুর্নীতির দুষ্টচক্র - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাব্যবস্থা ঘিরে দুর্নীতির দুষ্টচক্র

মাছুম বিল্লাহ |

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির কয়েকটি চিত্র ফুটে উঠেছে যা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষকের যোগদান, সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা, পাঠদান অনুমোদন, স্বীকৃতি নবায়ন থেকে শিক্ষক বদলিতে ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া প্রতিবেদনে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতাসহ অনিয়ম, সীমাবদ্ধতা ও ভাল-মন্দ নানা চিত্র উঠে এসেছে। স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ, বদলি থেকে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিকে সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে পনের লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। শিক্ষক বদলিতে জনপ্রতি এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়।

এই বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকে মধ্যস্বত্বভোগী এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশকৃতদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা, সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগে দুই থেকে তিন লাখ টাকা, শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ টাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষায় ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা, পাঠদান অনুমোদন এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা, স্বীকৃতি নবায়ন ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং শিক্ষক বদলিতে এক থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করা হয়। কোথায় যোগ্যতা, কোথায় সততা আর কোথায় পেশাদারিত্ব? শিক্ষকতা পেশা তো অন্য যে কোনো পেশা থেকে আলাদা, এটিকে তো অন্য কোনকিছুর সাথে তুলনা করলে চলবে না।

টিআইবির প্রতিবেদনের ব্যাপারে শিক্ষক নেতারা  বলেন, ‘‘ টিআইবির রিপোর্ট সঠিকই। তাদের রিপোর্টে ঘুষের যে টাকার কথা বলা হয়েছে, সেটি কম-বেশি হতে পারে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গেই পরিচালনা পরিষদ জড়িত। তাদের অনৈতিক চাহিদা মেটাতে গিয়েই অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককেও অনিয়মের আশ্রয় নিতে হয়। তারা ম্যানেজিং কমিটির প্রথা বাতিলের দাবি জানান। এমপিও পেতে মাউশির মাঠপর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব স্তরেই কম-বেশি ঘুষ দিতে হয়। এই ঘুষ বন্ধে একমাত্র  সমাধান হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।’ স্থানীয় দুর্নীতিপরায়ণ ও প্রভাবশালীদের হাত থেকে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ মুক্তি চায়, এটির সাথে আমরাও একাত্মতা ঘোষণা করছি। দেশের শিক্ষাকে, ভবিষ্যত উপযুক্ত নাগরিক তৈরির কারখানাগুলোকে এভাবে পেশীশক্তির অধিকারীদের নেতৃত্বে কিংবা বলয়ে থাকতে দেওয়া ঠিক নয়। যার কারণে চলছে এসব ঘুষবাণিজ্য। প্রশ্ন হচ্ছে- প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেই কি দুর্নীতি কমবে? সরকারি শিক্ষকদের বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন সবক্ষেত্রেই তো দুর্নীতি বিদ্যমান। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে অন্তত আট পর্যায়ে সেবাপ্রার্থীদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে রয়েছে অনিয়ম। নিয়ম লঙ্ঘন করে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে তিন বছরের অধিক এবং কেউ কেউ যুগের পর যুগ একই কর্মস্থলে থাকছেন।

এভাবেই পদে পদে বিরাজ করছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত না হলে দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা কঠিন। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমন ঘটনা ঘটলে তা কতটা ভয়াবহ চিন্তা করতে হবে এবং সেটি এড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে জাতীয় বিভিন্ন কৌশল নির্ধারন করা হলেও নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতি হলেও এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও নীতিগতভাবে প্রাধ্যান্য না পাওয়ায় শিক্ষা আইনটি এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নয় এবং বরাদ্দ টাকার অঙ্ক ক্রমান্বয়ে বাড়লেও শতাংশের ক্ষেত্রে এটি গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।

শিক্ষাখাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ছয় শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা,  বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনিসেফ। কিন্তু বাংলাদেশের গত ১০ বছরের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শতকরা হিসাবে এটি ১০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো শিক্ষাখাতে জিডিপির প্রায় তিন শতাংশ থেকে ছয় শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তাই এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে বৃদ্ধি করা, দ্রুত অবসর ভাতা প্রদানে বাজেটে বরাদ্দ রাখা এবং নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের অধিকতর দক্ষ করে তুলতে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় অর্থ ও অন্যান্য বিষয়ে রক্ষণাবেক্ষনে প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুকূলে আর্থিক বরাদ্দ প্রদান করার সুপারিশ করেছে টিআইবি।

দুর্নীতি বন্ধে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে জাতীয়করন করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে টিআইবি। দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে দেশের স্বার্থে, শিক্ষার স্বার্থে এবং সর্বোপরি ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা স্মরণে রেখে।

লেখক : ব্রাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্ট

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046529769897461