শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের বিকল্প নেই - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের বিকল্প নেই

মো. জহির উদ্দিন হাওলাদার |

বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তকরণ, পদোন্নতি প্রদান, উচ্চতর গ্রেড প্রদান ও বেতন ভাতার সরকারি অংশ প্রদানের কাজ সহজতর ও গতিশীল করতে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করতে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ (টিএমইডি) সৃষ্টি করেছেন।

মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার কোন কমতি দেখা যায় না। কিন্তু কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ (টিএমইডি) সরকারের উদ্দেশ্য ও শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। টিএমইডি আজ পর্যন্ত সৃষ্টিশীল কোনো কাজ করতে না পারলেও অসঙ্গতিপূর্ণ মাদরাসার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ প্রকাশের মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার করতে পেরেছে।

ওই নীতিমালা প্রকাশের পর থেকেই মাদরাসায় কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিনিয়ত ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁদের কোন কথায় কর্ণপাত না করে, সব দাবি উপেক্ষা করে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে অস্পষ্ট ও অসংগতিতে ভরা একটি দায়সারা সংশোধনী প্রকাশ করেছে। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষায় টিএমইডি'র এরকম অসঙ্গতিপূর্ণ সংশোধনী প্রণয়নে শিক্ষক সমাজ হতবাক।

এই সংশোধনীতে প্রভাষকদের ৫০ শতাংশ হারে সহকারী অধ্যাপক/জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদে পদোন্নতির বিধান রাখা হলেও পদোন্নতি বঞ্চিত প্রভাষকদের উচ্চতর গ্রেড প্রদানে চরম বৈষম্য করা হয়েছে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী চাকরিকাল ৮ বছর পূর্তিতে ৫০ শতাংশ প্রভাষক সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন এবং পদোন্নতি বঞ্চিত প্রভাষকরা চাকুরিকাল ১০ বছর পূর্তিতে ৯ম গ্রেড থেকে ৮ম গ্রেডে বেতন ভাতার সরকারি অংশ পাবেন। একই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও একজন প্রভাষক সহকারী অধ্যাপক হবেন, আর অপরজন পদোন্নতি না পাওয়ার একবুক যন্ত্রণা নিয়ে অতিরিক্ত আরও ২ বছর শিক্ষকতা করে ৯ম গ্রেড থেকে ৮ম গ্রেড পাবেন  -এমনটা কোনভাবেই কাম্য নয়। 

এছাড়াও স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালার সাথে মাদরাসা জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালার অনেক অসামঞ্জস্য রয়েছে। 

স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ তে শিক্ষায় অর্জিত ডিগ্রি বা বিএড স্কেল উচ্চতর গ্রেড হিসাবে বিবেচিত হবে না এবং বিএড স্কেল বাদেই সহকারি শিক্ষকরা চাকরি জীবনে দু'টি উচ্চতর গ্রেড পাবেন বলে স্পষ্টভাবে বলা থাকলেও মাদরাসার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ ও এর সংশোধনীতে এ বিষয়ে পরিষ্কার কোন ব্যাখ্যা নেই। এছাড়াও স্কুলে সিনিয়র শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হলেও মাদরাসায় এই পদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

স্কুল- কলেজের নীতিমালায় উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তিতে কোনো শিক্ষকের বেতন কমলে বা ধাপ না মিললে পরবর্তী উচ্চ ধাপে বেতন নির্ধারণের নির্দেশনা দেওয়া আছে, কিন্তু মাদরাসার নীতিমালায় এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া নেই।

স্কুল-কলেজের নীতিমালায় ৫০ শতাংশ হারে প্রভাষকদের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক/ সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ০.৫ বা তার বেশি হলে পরবর্তী পূর্ণ সংখ্যা বিবেচনা করার নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু মাদরাসা নীতিমালায় স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই।

এছাড়া স্কুল-কলেজের নীতিমালায় চাকরিকাল ১৬ বছর পূর্তিতে সকল প্রভাষকদের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক/ সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু মাদরাসা নীতিমালায় এ সুযোগ রাখা হয়নি।

স্কুল-কলেজের নীতিমালায় উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ডিগ্রি কলেজে উন্নীত হলে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদ সহকারী অধ্যাপক পদে পরিবর্তন হবে বলা থাকলেও মাদরাসার নীতিমালায় আলিম মাদরাসা ফাজিল মাদরাসা উন্নিত হলে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদ সহকারী অধ্যাপক পদে পরিবর্তন হবে কিনা তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এছাড়াও প্রভাষক (জীববিজ্ঞান), সহকারী শিক্ষক (কৃষি) পদে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতায় অস্পষ্টতা লক্ষ করা গেছে এবং এবতেদায়ী স্তরের জুনিয়র মাওলানা ও জুনিয়র শিক্ষক পদের নামকরণেও অস্পষ্টতা দেখা যায়।

স্কুল-কলেজের নীতিমালায় উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষ ও ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে জ্যেষ্ঠ প্রভাষকদের আবেদনের সুযোগ থাকলেও মাদরাসা নীতিমালায় আলিম মাদরাসা অধ্যক্ষ ও ফাজিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে জ্যেষ্ঠ প্রভাষকদের আবেদনের সুযোগ রাখা হয়নি। পাশাপাশি এই নীতিমালায় প্রভাষকদের বঞ্চিত করে এবতেদায়ি প্রধান, দাখিল মাদরাসার সহ-সুপার ও সুপারকে উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের সুযোগ রেখে একটি লজ্জাজনক অধ্যায়ের জন্ম দেয়া হয়েছে, যা বিশ্বের কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। এই নীতিমালায় মাদরাসার জেনারেল (নন্ অ্যারাবিক)  শিক্ষকদেরকেও প্রশাসনিক পদে নিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়নি।

উল্লেখ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জারি করা পরিপত্রে সহকারী শিক্ষককে (নন অ্যারাবিক) দাখিল মাদরাসা সহসুপার ও সুপার পদে এবং প্রভাষক/ সহকারী অধ্যাপক (নন অ্যারাবিক) কে আলিম মাদরাসা অধ্যক্ষ ও ফাযিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল, যা বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসাবে সুধী মহলে প্রশংসিত হয়। কিন্তু ২০১৩ সালে জারি করা সংশোধিত পরিপত্রে প্রশাসনিক (সহ-সুপার, সুপার, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ) পদের জন্য আরবি বিষয়গুলোতে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়, যার মাধ্যমে দাখিল, আলিম, ফাযিল, কামিল সকল পর্যায়ের মাদরাসা প্রশাসনিক (সহ-সুপার, সুপার, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ) পদে জেনারেল ( নন অ্যারাবিক) শিক্ষক নিয়োগের বিধান স্থগিত হয়ে যায়। 

শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও ২০ শতাংশ বৈশাখী (নববর্ষ) ভাতা চালু করেন। সম্প্রতি মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায্য ইনক্রিমেন্ট প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছে মতো কাউকে ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছে, কাউকে ইনক্রিমেন্ট দেয়ার পর কেটে নিচ্ছে, আবার কারো প্রাপ্যতা থাকা সত্ত্বেও ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছে না। এতে করে শিক্ষকদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। টিএমইডি এখনও সমাধানের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে, অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে একটি আদেশ জারি করে স্কুল- কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের ইনক্রিমেন্ট জটিলতা নিরসন করেছে। 

মাদরাসার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ (২৩ নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সংশোধিত) এর সকল অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্য একযোগে দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ না করে টিএমইডি বিচ্ছিন্নভাবে গত ৩০ মে প্রভাষক (জীববিজ্ঞান), সহকারী শিক্ষক (কৃষি) পদের এবং ৩ আগস্ট এবতেদায়ি স্তরের জুনিয়র মৌলভী ও জুনিয়র শিক্ষক পদের নামের স্পষ্টীকরণের আদেশ জারি করে শিক্ষক সমাজকে হতাশ করেছেন।

এছাড়া জাতীয়করণের ক্ষেত্রেও মাদরাসাগুলো বৈষম্যের শিকার। প্রধানমন্ত্রী ছয় শতাধিক স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় এখনও একটি মাদরাসাও জাতীয়করণ করেননি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার ভীত রচনা করেছিলেন। সে সময় তিনি একসঙ্গে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৬২ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেছিলেন। তিনি বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শনই ছিল শিক্ষার জাতীয়করণ। 

শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং একটি টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের কোন বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আজ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তাতে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য অর্থ যোগান দেওয়ার সক্ষমতা সরকারের আছে। 

লেখক: মো. জহির উদ্দিন হাওলাদার, সভাপতি, বাংলাদেশ মাদরাসা জেনারেল টিচার্স এসোসিয়েশন 

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035691261291504