শিক্ষাভবনে এবার ‘বিষয়’ পরিবর্তনে কেলেঙ্কারি - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাভবনে এবার ‘বিষয়’ পরিবর্তনে কেলেঙ্কারি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তাদের নিয়োগ হয়েছিল বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদার গেজেট প্রকাশ করার আগে এবং চাকরি স্থায়ীকরণের সময় নিয়োগকালীন বিষয় পরিবর্তন করে তারা ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞানের মতো বিষয়ের শিক্ষক ‘বনে’ যান। শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ‘আশকারাতেই’ আট বছর আগে শিক্ষকরা এ কেলেঙ্কারির সুযোগ পেয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। অথচ মাউশির কোনো নিয়মই শিক্ষকদের এ বিষয় পরিবর্তনকে ‘মান্যতা’ দেয় না। কিন্তু মাউশি তা জেনেও নির্বিকার।

এদিকে একই শিক্ষাবর্ষে ১৯৮৭ সালে দিনাজপুর জিলা স্কুলের সামাজিক বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক আবুল কাসেম মিয়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিএ (সম্মান) এবং ওই বছরেই দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএসএস ডিগ্রি লাভ করেছেন। এছাড়া আরো চারজন শিক্ষক একই বছরে এমএ, বিপিএড এবং বিএড ডিগ্রি লাভ করেছেন।

জানতে চাইলে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির প্রচার সম্পাদক ও খিলগাঁও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক তপন কুমার শীল অনৈতিকভাবে শিক্ষকরা যে বিষয় পরিবর্তন করেছেন, তা মেনে নিয়েবলেছেন, সর্ষের মধ্যে ভূত রয়েছে। তার মতে, বিষয় পরিবর্তন করে ইংরেজি, গণিতের শিক্ষক হতে পারলে লাভ বেশি। অথচ বিধি অনুযায়ী যে বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন, সে বিষয়েই তাকে পাঠদান করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০১২ সালে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পান। ওই সময়ই নামি স্কুলের দেড় শতাধিক শিক্ষক বিষয় পরিবর্তন করে ইংরেজি, গণিতের শিক্ষক হয়ে যান। প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং বাণিজ্য জমিয়ে তুলতে মাউশির কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় শিক্ষকরা এ কেলেঙ্কারির জন্ম দেন। কতিপয় শিক্ষক যখন অবৈধভাবে বিষয় পরিবর্তন করেন, তখন মাউশিতে মহাপরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন অধ্যাপক মো. নোমান-উর-রশীদ। সে সময় সরকারি মাধ্যমিক শাখায় উপপরিচালক ছিলেন এ কে এম মোস্তফা কামাল ও সহকারী পরিচালক ছিলেন সাখাওয়াত হোসেন বিশ্বাস। একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করে বলেছেন, বিপুল পরিমাণ টাকা ‘ঘুষ’ পেয়ে মাউশিতে এ বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ঘটে। সম্প্রতি বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে।

মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান-উর-রশীদ সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। সেখানে আট বছর কাজ করার পর এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। উপপরিচালক এ কে এম মোস্তফা কামাল এখন ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত। আর সাখাওয়াত হোসেন বিশ্বাসকে মাউশির সহকারী পরিচালক থেকে বদলি করে ঢাকার আঞ্চলিক উপপরিচালক পদে পাঠানো হয়। কিন্তু লাগামহীন দুর্নীতির কারণে তাকে সেখান থেকে আট মাস আগে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি আবু সালেহ আহমেদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে বদলি করা হয়। আট মাস আগে বদলি করা হলেও গত সপ্তাহে তিনি নাইক্ষ্যংছড়িতে গিয়ে যোগদান করেন।

বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলে এ প্রতিবেদকের কাছে মাউশির মাধ্যমিক শাখার বর্তমান উপরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন যেসব বিষয়ের শিক্ষকরা বিষয় পরিবর্তন করেছেন, তার একটি তালিকা বা তথ্য জানতে চান। পরে প্রতিবেদক একটি তালিকা দিলে তিনি সেটি সংরক্ষণে রাখেন এবং এক সপ্তাহ সময় নিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, শিক্ষকরা কীভাবে বিষয় পরিবর্তন করলেন, তা আমরা খতিয়ে দেখে আপনাকে জানাব। কথামতো ১২ দিন পরে বিষয়টি নিয়ে ফের যোগাযোগ করা হলে উপপরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন জানান, বিধিবিধান অনুযায়ী যে বিষয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ হয়েছিল, পরে সেই বিষয় পরিবর্তন করার নিয়ম নেই। কিন্তু এখানে দেখা গেছে কিছু শিক্ষক বিষয় পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু কীভাবে বিষয় পরিবর্তন হয়েছে, তার বিস্তারিত আমরা পাচ্ছি না। তবে এটা অন্যায়। কিন্তু এই অন্যায় কাজ আমাদের সময়ে হয়নি। তাই আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।

প্রায় একই কথা বলেছেন মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, আমার সময়ে মাউশিতে কোনো দুর্নীতি হতে দেইনি। সঙ্গত কারণে আগের দুর্নীতির দায়ও আমি নেব না। সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান-উর-রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ের মাউশির মাধ্যমিক শাখার উপপরিচালক এ কে এম মোস্তফা কামাল বলেন, মহাপরিচালকের অনুমতিক্রমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়ে বিষয় পরিবর্তনের আবেদন করতে পারেন। এমন নিয়ম না মেনে কোনো শিক্ষক যদি বিষয় পরিবর্তন করেন, তাহলে সেটা অন্যায় হবে। কিন্তু অনুমতি ছাড়াই শিক্ষকদের বিষয় পরিবর্তন আপনার সময়কালে ঘটেছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার সময়কালে এমনটি ঘটেনি। তবু যদি কোনো শিক্ষক এমনটি করে থাকেন, তাহলে তারা তথ্য গোপন করে করেছেন এবং এজন্য ওই ব্যক্তি দায়ী। কোনোভাবেই আমি দায়ী নই। তৎকালীন সহকারী পরিচালক সাখাওয়াত বিশ্বাসেরও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ভোলার তজুমদ্দিনের চাঁদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, শিক্ষকদের খসড়া গ্রেডেশন তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যে শিক্ষকরা ১৯৭১/৭২ সালে জন্ম দেখিয়েছেন এবং ১৯৯১ সালে যোগদানের আগে যে সনদ দেখিয়েছেন, তার সঙ্গে বয়সের কোনো সমন্বয় নেই। তাদের জমা দেয়া সনদগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা মাত্র ৯ বছর বয়সে দাখিল পাস করেছেন। এটা কীভাবে সম্ভব? এগুলো কর্তৃপক্ষের নজরে আনার চেষ্টা করা হলেও তারা তা আমলে নিতে চাননি। এই দাখিল পাস করারাই বিষয় পরিবর্তন করে এখন ইংরেজি, গণিতের শিক্ষক বনে গেছেন বলে জানান তিনি।

নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, আব্দুস সালামের নিয়োগ হয়েছিল বাংলার শিক্ষক হিসেবে। নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত এ শিক্ষক এখন হয়ে গেছেন ইংরেজির। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গভ. মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত হিমানি। তার নিয়োগকালীন বিষয় ছিল সামাজিক বিজ্ঞান। কুমিল্লার ফয়জুনন্নেসা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত আব্দুর রহিম বাংলার শিক্ষক হলেও বিষয় পরিবর্তন করে এখন ইংরেজির শিক্ষক হয়েছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত ধর্মের শিক্ষক আব্দুস সালাম এখন ইংরেজির শিক্ষক। একইভাবে রাজশাহীর মোহনপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক স. ম. আবু হেনা এখন ইংরেজির, খুলনার গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের শিক্ষক কবির আলম বাংলার পরিবর্তে এখন ইংরেজি, চুয়াডাঙ্গার ভি. জে. উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি, ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের বিএসসি শিক্ষক দাউদ উর রহমান এখন ইংরেজির, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক আবু তাহের এখন ইংরেজির, নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের বিএসসি শিক্ষক শাহীনা ইয়াসমীন এখন ইংরেজির, বরিশাল জিলা স্কুলের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক স্বপন কুমার বাড়ৈ এখন ইংরেজির, বসুরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মের শিক্ষক আব্দুর রহিম এখন ইংরেজির, ঢাকার গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক মো. শহীদুল্লাহ এখন ইংরেজির, ঢাকা কলেজিয়েট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. দবির উদ্দিন সামাজিক বিজ্ঞান পাল্টে ইংরেজি, ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক মনোয়ারুল ইকবাল বিষয় পাল্টে এখন গণিত, কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত তুষার কুমার সামাজিক বিজ্ঞানে নিয়োগ থাকলে তা পাল্টে এখন গণিত, নাটোর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত বদরুল হোসেন বাংলায় নিয়োগ পেলেও বিষয় বদলে তিনি গণিতের, বরিশালের আরজুমনি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃষি বিজ্ঞানে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক এমাদুল হক বিষয় পাল্টে ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং চুয়াডাঙ্গা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভৌত বিজ্ঞানে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক হাসানুজ্জামান এখন গণিত বিষয়ে কর্মরত।

জানতে চাইলে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির নেতা আব্দুস সালাম বলেন, যে বিষয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন পরে তা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তবে কর্তৃপক্ষ চাইলে তা হতে পারে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলছে, এমন বিধান নেই- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিধান নেই কিন্তু প্রচলন আছে।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0069169998168945