শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থাকে সবারই বিবেচনায় রাখতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থাকে সবারই বিবেচনায় রাখতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এবার অন্তত সবাই বিশ্বাস করছেন ধাপে ধাপে খুলে যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কভিডের চোখ-রাঙানি কমে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে ভ্যাকসিন কার্যক্রম। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুদূর অতীতেও বিশ্বে জীবাণু সংক্রমণের বড় বড় মহামারি মানুষের জীবন বিপন্ন করেছিল। প্রায় বেশির ভাগ মহামারিই দেড় থেকে দুই বছরে দুর্বল হয়ে গেছে। তাই আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, যদি আমরা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মান্য করে চলি, তবে এবারেই বোধ হয় করোনাকে চিরতরে বিদায় করতে পারব। করোনার কশাঘাতে দেশের সব ক্ষেত্রই জর্জরিত। একসময় অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে একে একে বেশির ভাগ ক্ষেত্র খুলে যেতে থাকে। বাকি ছিল শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই তালা ঝুলছিল দেড় বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত। তাই এক ধরনের উৎসবের আনন্দ চলছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আমরা জানি এমন সংকটে মনস্তাত্ত্বিক চাপেও আছে অনেক শিক্ষার্থী। এখন প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া ধাপে ধাপে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত এসেছে মন্ত্রণালয় থেকে। অক্টোবরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত এলেও তারিখ ঘোষণার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিন্ডিকেট দ্রুতই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আমরা বিশ্বাস করি স্বাস্থ্যবিধি যথানিয়মে পালন করলে আবার শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতে পারব। শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায় তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে বিবেচনায় রাখতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবাইকে। শিক্ষার্থীদের ওপর দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বড় ঝড় বয়ে গেছে। শিক্ষকরাও যে মানসিকভাবে খুব স্বস্তিতে ছিলেন তেমন নয়। বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মারাত্মক আর্থিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে এই বিভীষিকাময় দেড় বছর কাটাতে হয়েছে। এসব নানা কারণে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পরিবেশ খুব সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকবে তেমন ভাবা ঠিক হবে না। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থাকে সবারই বিবেচনায় রাখতে হবে। আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক বেশি থাকবে। বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটিকেও সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাঠদান পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হতে পারে। আনন্দময় করে তুলতে হবে শ্রেণিকক্ষ।

কভিডকালে শিক্ষার্থীদের একটি বড় ক্ষতি হয়েছে এটি যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য সারা বিশ্বই এই সংকটের মুখোমুখি ছিল, এখনো আছে। সবারই একটি যুদ্ধের ময়দানে থাকার দশা। যে যুদ্ধ এখনো থামেনি। তাই এই ক্ষতির কষ্ট বিশ্বের সবার মধ্যে ভাগ করে নিলে মানসিক চাপ অনেকটা কমবে। যুদ্ধ যেহেতু থামেনি, তাই সতর্কভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতি রাখার কথাও শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলে বোঝানোর কথা নয়। সবারই উপলব্ধি করা উচিত নিজের, পরিবারের, সমাজের ও দেশের কল্যাণে তাঁদের কী ভূমিকা পালন করতে হবে।

আমরা মনে করি দীর্ঘ সময় পর স্কুলগুলো খুলে গেলে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা অনেকে আগের স্বাভাবিক ছন্দ হয়তো খুঁজে পাবে না। শুধু মানসিক সংকট নয়, বাস্তব সমস্যায়ও তারা পড়বে। এখন তাদের মাস্ক পরে ক্লাসে আসতে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। মাঝেমধ্যে হাত ধুতে অথবা স্যানিটাইজ করতে হবে। এসব বাধ্যবাধকতার পর বন্ধুদের নিয়ে মাঠে তেমনভাবে ছোটাছুটি বা খেলাধুলা করা যাবে না। এ সব কিছু নতুন ধরনের মানসিক চাপ বাড়াতে পারে। তাই বিষয়গুলো পরিবার ও শিক্ষকদের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। এসবের আলোকে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করানোর দায়িত্ব রয়েছে।

স্কুলে শিক্ষা কারিকুলাম বা পাঠ্যসূচিতে কিছু পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আমাদের স্কুল পাঠ্যসূচি বা কারিকুলামের উদ্দেশ্য নানা বিষয়ে পাঠ গলাধঃকরণ করিয়ে শিক্ষার্থীকে সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী করে তোলা। যা কখনো বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা হতে পারে না। প্রাচীন ভারতের বস্তুবাদী চার্বাক দর্শন আদিকালেই সে সত্য প্রচার করেছে। সেই অন্ধের হস্তিদর্শনের কথা আমরা জানি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চার্বাক দার্শনিক চিন্তার বিরুদ্ধ প্রতিফলনই দেখতে পাই। আসলেই কি একজন মানুষ জ্ঞান-প্রতীক হস্তী সম্পর্কে পুরোটা জানতে পারে? পারে না বলেই যার যার চর্চামতো কেউ কান ছুঁয়ে বলছে হাতি কুলোর মতো, পা ছুঁয়ে বলছে থামের মতো, শরীর ছুঁয়ে বলছে দেয়ালের মতো। সত্যিই তো একজীবনে সমুদয় জ্ঞান অর্জন প্রায় অসম্ভব। অথচ আমাদের পাঠক্রম দেখলে মনে হবে নানা জ্ঞানের ভারে ভারাক্রান্ত করে তুলতে চাই আমাদের শিক্ষার্থীদের। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী—কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকও ভার লাঘবের জন্য হাতে তোলে নেন গাইড-নোট বইয়ের সরল পথ। ফলে আমাদের শিক্ষার প্রাপ্তি খুঁজতে গেলে না ঘরকা না ঘাটকা দশা খুঁজে পাই। দীর্ঘ বিষময় বিরতির পর এসব সত্যের মূল্যায়ন প্রয়োজন। ক্লাসকে আনন্দময় করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি গাইডলাইন আসা উচিত।

আমাদের সব পর্যায়ের শিক্ষার একটি বড় বিষফোড়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাক্রান্ত করা। বিশ্ব যখন চিন্তা করছে প্রথাগত পরীক্ষাকে কমিয়ে কিভাবে শিক্ষার্থীকে জ্ঞানমুখী করা যায়, সেখানে আমাদের দায়িত্বশীলরা গবেষণা করছি কিভাবে আরো বেশি পরীক্ষার বলয়ে ঢুকিয়ে গাইড বই নির্ভর করে তোলা যায়। এমন চিন্তা থেকে আমরা শিশু শিক্ষার্থীদের পিইসি পরীক্ষার মতো একটি তথাকথিত পাবলিক পরীক্ষায় প্রবেশ করাতেও কিছুমাত্র দ্বিধা করিনি। নানা সমালোচনার পর মনে করেছিলাম কভিড-উত্তর ক্লাসে ফিরে গেলে হয়তো পিইসির খড়্গ ঘাড়ের ওপর থেকে সরিয়ে ফেলা হবে। কিন্তু না, সংবাদমাধ্যমে জানলাম বর্তমান বাস্তবতায় শিশুমনস্তত্ত্ব নিয়ে না ভেবে আবার পিইসির আয়োজন করা হচ্ছে। আসলে কোথায় যে কী মধু আছে আমরা ঠিক জানি না। বাংলাবাজারের এক গাইড বই ব্যবসায়ী হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমাদের ঠেকানোর সাধ্য আপনাদের নেই।’

নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবনার অনেক কিছু রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশেষ চাপের মুখে আছে। বিভিন্ন বর্ষ আর সেমিস্টার সেশনজটের মুখে পড়েছে। যাঁরা অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ছিলেন তাঁদের অনেকে গুনছেন চাকরির বাজারে যুদ্ধ করার সময় কতটা কমে যাচ্ছে। এসব কারণে মানসিকভাবে কারোরই ভালো থাকার কথা নয়। শিক্ষার্থীদের সময়ের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটি শিক্ষকদেরই নিতে হবে। আমি সিলেবাস ছোট করে বৈতরণি পাড়ি দেওয়ার পক্ষে নই। একেকটি কোর্সের পাঠক্রম ধারাবাহিকভাবে সাজানো হয় বিশেষ ধারণাকে পূর্ণতা দেওয়ার লক্ষ্যে। একে মাঝখান থেকে ছোট করার অর্থ হচ্ছে বিকলাঙ্গ করে দেওয়া। এর চেয়ে ভালো বিষয়গুলো কেমন করে সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় তা নিয়ে ভাবা। আমি জানি অতিরিক্ত সময় ক্লাস নিতে অতীতের মতো শিক্ষকরা পিছপা হবেন না। তবে আমাদের গত্বাঁধা পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনার অহেতুক চাপ থেকে কিভাবে কতটুকু মুক্ত করা যায় তা নিয়ে গভীর ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।

একটি আশঙ্কা রয়েছে ক্যাম্পাসে একটি ছাত্রসংগঠনের দাপট দেখানো প্রসঙ্গে। এমনিতেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীরা সব পর্বেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চান। ফলে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির জায়গাটি সেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বিবেচনা করতে সাহায্য করে না। এসব নিয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ক্যাম্পাস খোলার আগেই একটি শঙ্কা কাজ করছে। আমার মনে হয় দীর্ঘ জরার পর মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের সুস্থতার পক্ষে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সবারই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত।

মনে পড়ে ঘন ঘন জঙ্গি আক্রমণের পর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মতৎপরতা বাড়ানোর জন্য সরকারিভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। এসব প্রচারণার জন্য জনপ্রতিনিধিদের আমন্ত্রণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা করতে যেতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু অচিরেই লক্ষ করেছি এ সবই ফাঁকা বুলি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের কর্মীরা নিয়মিত চর্চা করেন। নাটক, আবৃত্তি, গান, বিতর্ক ইত্যাদির আয়োজন করেন বছরব্যাপী। নিজেদের পকেটের পয়সা দিয়েই তাঁরা বুনোমোষ তাড়ায়। আগে বড় কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বিভিন্ন ব্যাংক ও কম্পানির স্পন্সর পাওয়া যেত। এখন সব সীমিত হয়ে গেছে। সরকারিপক্ষ বলেই খালাস, এসব সংগঠনকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে কখনো দেখিনি। এখন এই পরিবর্তিত পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের উচিত হবে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে প্রণোদিত করা।

আমরা আশা করব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থানকে ভবিষ্যতের জন্য নিরুদ্বিগ্ন করবে। সহানুভূতির সঙ্গে নীতিনির্ধারণ করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকরা তাঁদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও একাডেমিক জায়গাগুলো সুস্থ রাখার জন্য ঘনিষ্ঠভাবে নিজেদের যুক্ত রাখবেন। কভিডের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করছি সেখানে আমাদের জয়কে সুনিশ্চিত করতে হবে। আশা করব, আবার আমাদের শিক্ষাঙ্গন শিক্ষার্থীরা মুখরিত করে তুলবে।

 

লেখক : এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053880214691162