ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে পারেনি। কারণ শুরু থেকেই রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। রাজনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর রাষ্ট্র এটাকে খুব পছন্দ করেছে, তা নয়। কেননা ইংরেজবিরোধী আন্দোলন হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রের সঙ্গে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শত্রুতাই লেগে গেল। তাই পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালো চোখে দেখেনি। বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা যাতে রাজনীতি করতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্র তৎপরতা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে রাষ্ট্র যেটা করল, সেটা ভয়ংকর। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে। প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আক্রমণ করে ছাত্র-শিক্ষক হত্যা করেছে। তারপর তারা বেছে বেছে ফের (একাত্তরের শেষলগ্নে) শিক্ষকদের হত্যা করেছে।
একাত্তরের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক, তা-ও রাষ্ট্রের দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতামূলক হয়নি। এর অন্যতম কারণ রাষ্ট্রের যে পরিবর্তন বা বিকাশ ছিল, শিক্ষার্থীরা তা সমর্থন করতে পারেনি। এটা হলো একটা দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন তো আছেই, একই সঙ্গে অন্য দায়িত্বও পালন করেছে।
আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’
আরেকটা দিক হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয় যে দায়িত্ব পালন করেছে, সেটা হলো সামাজিক দায়িত্ব। কেননা পূর্ববঙ্গের একটা সমাজ ছিল পশ্চাৎপদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছিল এই পশ্চাৎপদ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরেকটা কাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধারাবাহিকভাবে করেছে। সেটা হচ্ছে, একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশকে সাহায্য করেছে।
এই শ্রেণি যে কেবল মুসলমানদের মধ্য থেকে মধ্যবিত্ত তৈরি করেছে তা নয়, হিন্দুদের মধ্যেও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ভূমিকা রেখেছে। এই মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটানোটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় একটি ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি দিক হচ্ছে, এটি সব সময় ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। যখন ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা ছিল, তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। এই বিশ্ববিদ্যালয় ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানরূপে থেকে অসাম্প্রদায়িকতা লালন করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। আবাসিক হলগুলোয় সামাজিক জীবন গড়ে উঠবে, ছাত্রদের মধ্যে আদানপ্রদান হবে এবং ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যেও আদানপ্রদান হবে, কেননা শিক্ষকরাও এই হলগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকেন। আর এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল।
ছাত্র সংসদের মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়েরা মেধা বিকাশের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। এছাড়া সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলা করতে পারে। লিখতে ও বক্তৃতা করতে পারে। এই সুযোগগুলো আবাসিক হলকেন্দ্রিক ছিল আর এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত ছাত্র সংসদ। একসময় ছাত্র সংসদের নির্বাচন ?উৎসবের মতো ছিল। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও এই নির্বাচন হয়েছে। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামরিক শাসনামলেও ছিল।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
কিন্তু দুঃখজনকভাবে ১৯৯১ সালের পর ছাত্র সংসদে নির্বাচন আর হয় না। একবারই হলো; কিন্তু সেটাও খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই যে হল-ছাত্র সংসদের মাধ্যমে সামাজিক বলয়ে থাকা, সেটাও জ্ঞানের চর্চায় একটা ভূমিকা রাখে। কারণ জ্ঞান তো কেবল দিলেই হবে না, ছাত্রদের গ্রহণও করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নয়। সমাজে জ্ঞানের মূল্য কমে গেছে, এবং জ্ঞান মর্যাদা পাচ্ছে না; সেই বাস্তবতা বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিফলিত।
ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ হলো, শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক আগের মতো নেই। পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করলে জীবিকার একটা সংস্থান হতো। বাংলাদেশ হওয়ার পর উন্নতি হয়েছে; কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়েনি। ফলে তরুণরা ভয় পায়, যখন তারা বের হবে বোধহয় বেকারত্বের মধ্যে পরতে হবে।
লেখক : ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়