শিক্ষাক্ষেত্রে এখন ক্রান্তিকাল। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দেশ ও জাতি যখন অশিক্ষার অভিশাপমুক্তির আশা করছে, ঠিক তখনই বৈশ্বিক মহামারির আঘাত থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। বিষয়টি নিয়ে নানা মুনির নানা কথা বাতাসে ভাসে। অনলাইনে মন্তব্যেরও অভাব নেই। বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, পত্রপত্রিকায় নানা মতের লেখা ছাপা হয়। তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত- সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান সম্ভব নয়। অনেকে ভার্র্চুয়াল ক্লাসের কথা বলেন। আজকের ডিজিটাল যুগে বিষয়টি বাস্তবায়নের সুযোগ অবারিত। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। যেখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ে পড়া আদায় করতে শিক্ষকরা হিমশিম খান, সেখানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভার্চুয়াল ক্লাস করে কীভাবে পড়া আদায় করা সম্ভব? অবশ্য শিক্ষা বাণিজ্যের প্রয়োজনে সবই সম্ভব!
নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারগুলোতে পাঠ্যবইয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ল্যাপটপ ও স্মার্টফোন। খোলা হয় ফেসবুক পেজ। আপলোড করা হয় উত্তরপত্রসহ প্রশ্ন। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জুমে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র পাঠায়। শিক্ষার্থী তার মর্জিমতো ডাউনলোড করতে পারে। এই হলো ভার্চুয়াল ক্লাসে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি।
নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন ভূমিকায় অন্যান্য শিক্ষালয় অস্তিত্ব সংকট উত্তরণে বাধ্য হয়ে ভার্চুয়াল ক্লাস পদ্ধতি চালু করেছে। স্বশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত অভিভাবকরা এমন যান্ত্রিক শিক্ষা নিয়ে বিপাকে পড়ছেন। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীর কাছে বিষয়টি যান্ত্রিক খেলার সামগ্রী বলে মনে হয়। এ মাধ্যমে অমনোযোগিতার কারণে শিক্ষকের বকুনি কিংবা চোখ রাঙানি ও পড়া আদায়ের ভয় নেই।
এমন শিক্ষা কতদিন বজায় রাখা সম্ভব, তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে। তারপরও নিরাশ হয়ে লাভ নেই। করোনার বিষাক্ত ছোবল থেকে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষার বিকাশে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এ পথেই হাঁটছে। অন্যদিকে, শিক্ষালয়ে ক্লাস বন্ধ বলে যেটুকু সময় ডিজিটাল পদ্ধতির ক্লাসে ব্যয় হয়, তারপরও অনেক সময় হাতে থাকে।
কর্মজীবী মা-বাবার সন্তানরা এ সময় পুরোই স্বাধীন। তারা মহল্লার সমবয়সিদের নিয়ে মাস্তানির চর্চা করে নেতৃত্বের কোন্দলে দ্বিধাবিভক্ত হয়। তৈরি হয় কিশোর গ্যাং। তারপরই শুরু হয় এক গ্রুপ কর্তৃক আরেক গ্রুপকে ঘায়েল করার নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা, যা চুরি থেকে শুরু করে খুনখারাবি পর্যন্ত সব ধরনের অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। ব্যস্ত অভিভাবকরা যখন জানতে ও বুঝতে পারেন, তখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। করোনার ছোবলে অসংখ্য শিশু-কিশোরের জীবনে নেমে এসেছে এমন অমানিশা।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আশা ছিল, ২০২০ সালের শেষে কিংবা ২০২১ সালের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। কিন্তু এ সময় শীতের কারণে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। এদিকে অটো পাসের প্রভাবে শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলছাড়া। কেউ আহ্লাদে আটখানা, কেউবা ভবিষ্যৎ অন্ধকার ভেবে দিশেহারা। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি-ইচ্ছুকরা ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হিমশিম খাচ্ছে। শিক্ষার গতিশীলতা ব্যাহত হওয়ায় বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে।
করোনার কারণে কোনোভাবেই শিক্ষার মূল স্রোতোধারা ফেরানো যাচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। শিক্ষকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারি, এমপিওভুক্ত বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত বেতনভাতা পেয়ে নিরাপদে আছেন। কিন্তু দেশের বেসরকারি কেজি স্কুল, উচ্চবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষক আর্থিক দীনতায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
কেউ বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে পেশা পরিবর্তন করে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কাঁচামাল, বস্ত্র কিংবা অন্য কোনো পণ্য ফেরি করে বিক্রি করছেন। কেউ লোকলজ্জার ভয়ে পরিচিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত অর্থাৎ কোড নম্বরপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের প্রণোদনা দিয়েছে ২০২০ সালের মাঝিমাঝি সময়ে।
দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষকরা কর্মহীন এবং অভিভাবক মহল উদ্বিগ্ন। অনেক কর্মহারা বাবা-মা তাদের সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিন্তিত। কেউ কেউ বাসা ছেড়ে গাঁয়ের পথে পা বাড়িয়েছেন। এমন স্থান পরিবর্তনে কর্মহারা মা-বাবার সন্তানদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন হবে। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।
শিক্ষার এমন ক্রান্তিকাল স্বাধীনতার পর আর কখনো আসেনি। মাদ্রাসা খোলা রেখে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন জাগছে। বিষয়টি উচ্চমহল খতিয়ে দেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেবে-এটাই প্রত্যাশা। কারণ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও জাতির ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।
বৈশ্বিক মহামারির কারণে শিক্ষা কার্যক্রম যদি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে, তাহলে প্রতিটি দেশ ও জাতির জন্য নতুন প্রজন্ম বোঝায় পরিণত হবে বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা। উন্নত ও সম্পদশালী দেশগুলোর নিজস্ব প্রযুক্তি ও সম্পদ থাকায় এমন বিপর্যয় মোকাবিলা তাদের জন্য সহজ হতে পারে। কিন্তু পশ্চাৎপদ বা উন্নয়নশীল দেশগুলো শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানে এখনই হিমশিম খাচ্ছে, পরে কী হবে তা ভেবে শঙ্কিত হই।
হাটবাজার, যানবাহন, মসজিদ, মাদ্রাসা-সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে চলেছে মানুষ। সরকার মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় এর ব্যবহার বেড়েছে। তবে হাটবাজারে গেলে দেখা যায়, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার তোয়াক্কা করছে না কেউ। তাই জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করে নতুন প্রজন্মকে অশিক্ষার অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করা জরুরি বলে শিক্ষক, অভিভাবক ও বিজ্ঞজন মনে করেন।
লেখক : মো. মাহবুবুর রহমান, প্রধান শিক্ষক,গাজীপুর