শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা

অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান |

শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। অর্থাৎ শিক্ষকই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তর করে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়; বরং শিক্ষকতা এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে-যুগে কালে-কালে তাই শিক্ষক জ্ঞানের দীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডার, অথচ কখনো প্রশ্ন করে দেখেননি প্রতিদানে তিনি কী পেয়েছেন! তাইতো শিক্ষক হলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ব বিষয়েই পূনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। শিক্ষকদের জন্যও শুরু হয় নতুন করে ভাবনা। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকোর এক সভায় বিশ্বের শিক্ষকদের জন্য একটি ‘সনদ’ প্রণয়নের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ঘোষণা করে, ‘শিক্ষা লাভ মানুষের মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের হাতিয়ার।’ এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ব শিক্ষক সংঘ গঠিত হয়। এরপর বিশ্বশ্রম সংস্থার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞদের এক সভায় শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা এবং তার সমাধানের জন্য কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর ইউনেসকোর এক সভায় বিশ্বের শিক্ষকতা পেশার জন্য কী দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কী অধিকার ও মর্যাদা তার জন্য ১৪৬ ধারা-উপধারা বিশিষ্ট একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়। এই ইউনেসকো-আইএলও রেকমেন্ডশন-১৯৬৬কেই (UNESCO/ILO Recommendation 1966) ‘শিক্ষক সনদ’ বলা হয়। বিশ্বের ১৭২টি দেশের ২১০টি শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ২৬তম অধিবেশনেরে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তৎকালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার ফলে ঐ সময় থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয় এবং বিশ্বের সব দেশে ‘শিক্ষক সনদ’ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।

কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে বর্তমান ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘ শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার মূলে রয়েছেন শিক্ষকরাই’ এই দিবসটি উদযাপনকালে সারাবিশ্বের শিক্ষকরা অতীতের সকল অর্জন ও ব্যর্থতার সমীক্ষা করবেন। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হবেন, যাতে কেউ শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। 

করোনা মহামারি উল্লেখযোগ্যভাবে শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকতার চ্যালেঞ্জকে অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত করেছে। একথা বলা নিশ্চয় অত্যুক্তি হবে না যে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় করোনা সংক্রমণের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা এক সংকটময় কাল অতিক্রম করছে। কোভিড-১৯-এর কারণে শিক্ষাব্যবস্থার বিপর্যস্ত অবস্থা ও সকল প্রতিবন্ধকতা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে সারা বিশ্বের মত আমাদের দেশের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাপকরা অনুকূল অবস্থা ফিরে পেতে তৎপর রয়েছেন।

আমাদের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের প্রশ্নে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ও শিক্ষা উপকরণ প্রদান করা হয় সত্য, কিন্তু শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন প্রগতিশীল, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা। শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এ বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। উল্লেখ্য, আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় ৯৭ ভাগই পরিচালনা করেন বেসরকারি শিক্ষকরা। আর একটি স্বাধীন দেশের জন্য এ বেসরকারি শিক্ষকতার অবস্থা অত্যন্ত লজ্জাজনক। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরেজ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে এক চার্টারে ১ লাখ টাকা মঞ্জুরির মাধ্যমে এদেশে সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সূত্রপাত করে। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ম্যাকলে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এদেশের অবস্থার সাথে সঙ্গতিহীন শিক্ষাকাঠামো প্রণয়ন করেন। ক্রমান্বয়ে শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে এদেশের ধনাঢ্য দানশীল শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের উদ্যোগে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবিভাগের পর প্রায় একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

১৯৭১ এ স্বাধীনতা অর্জনের পরেও চলমান ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে এবং তা সম্প্রসারিত হতে থাকে। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরকে সরকারিকরণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন ধারায় রূপান্তরিত করতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে শিক্ষকতা পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সে কারণে পৃথক ‘শিক্ষা সার্ভিস কমিশন’ গঠন করে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তেমনিই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং বা অন্য কোন বাড়তি কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। 

এখনও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও পদোন্নতির সুযোগ তেমন একটা নেই। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রাজনীতিকদের অন্তভূর্ক্ত করার ফলে এবং পরিচালনা কমিটি গঠনে অসঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরির কোন নিরাপত্তা নেই। যেহেতু সরকার বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতনের ১০০ শতাংশ ও প্রয়োজনীয় ভাতার আংশিক দিচ্ছে, তাই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ নিয়মে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। সামগ্রিক অবস্থার আলোকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, যোগ্য ও আদর্শ শিক্ষকরা এক চরম হতাশার মধ্যে দিন যাপন করছেন। ফলে সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটার অবকাশ নেই, বরং তাঁদের সাধারণ দায়িত্ব পালন করার স্পৃহাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। শিক্ষককে হতে হবে গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল। এখন প্রশ্ন, এই মহান পেশার প্রতি আমরা শিক্ষকরা কতটুকু যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটুকু আন্তরিক? এসব বিষয়ে শিক্ষকদের আত্মবিশ্লেষণের এখনই উপযুক্ত সময়। সুন্দর সমাজ, সুন্দর দেশ ও সুন্দর জাতি গঠনে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করা সম্ভব হবে, এই প্রত্যাশাই করি।

লেখক : অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান, সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ ও সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029139518737793