শিক্ষায় ঘুষ সিন্ডিকেট, আতঙ্কে ৬০০ ফেরিওয়ালা - Dainikshiksha

শিক্ষায় ঘুষ সিন্ডিকেট, আতঙ্কে ৬০০ ফেরিওয়ালা

নূর মোহাম্মদ |

শিক্ষাখাতে ঘুষ-দুর্নীতি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দপ্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ৬শ’র বেশি কর্মকর্তা এ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তারাই ‘ঘুষ কালেক্টর’ হিসেবে নিয়োগ দেন তার দপ্তরের অফিস সহকারীদের। মাঝে-মধ্যে শোরগোল হলে বলির পাঁঠা বানানো হয় এসব কর্মচারীকে। আর মূল হোতারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। শিক্ষার এই সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির একাধিক সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

সর্বশেষ শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব ও কর্মচারী নাসির গ্রেপ্তার হওয়ার পর এ সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষাভবন, এনসিটিবি, শিক্ষাবোর্ড, বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত সব কর্মকর্তার ব্যক্তিগত তথ্য ও কত বছর ধরে ঢাকায়- এই তথ্য চাওয়া হয়েছে। এরপরই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের মধ্যে। তালিকা অনুযায়ী, মাউশিতে শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত ১৩১ জন ক্যাডার কর্মকর্তার বেশিরভাগই এক দশক ধরে শিক্ষাভবনে ঘাপটি মেরে আছেন। মাঝেমধ্যে কাউকে বদলি করা হলেও অল্প সময়ে প্রাইজ পোস্টিং নিয়ে অন্য দপ্তরে হাজির হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মকর্তা নিজেদের শিক্ষামন্ত্রী ও সরকারের প্রভাবশালী কারও লোক বলে দাপট দেখান। এসব অভিযোগের মধ্যে গত বছরের ২রা অক্টোবর খোদ শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে নোট পাঠান। সেখানে তিনি লেখেন, আমার কাছে সারা দিন (সকাল ৬টা-রাত ১২টা) যত মানুষ আসেন, যত চাপ দেয়া হয়, তা মোট কাজের ৮০ শতাংশ ঢাকায় বদলি, সুবিধাজনক পদায়ন, ভিসি-চেয়ারম্যান ও বড় পদসহ কোনো কর্মকর্তার পদে পদায়ন করার। এছাড়াও আরো বেশকিছু নির্দেশনা ছিল সেই নোটে।

গত বছর ৬ই আগস্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও এ বিষয়টি আলোচনা হয়। সভায় এ নিয়ে শিক্ষা সচিবকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। একই পদে বছরের পর বছর একই ব্যক্তিরা কীভাবে থাকেন তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয় কমিটির পক্ষ থেকে। পাশাপাশি কমিটি সুপারিশ করেছে, বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থায় শিক্ষকদের পদায়ন করার পর তিন বছরের বেশি রাখা যাবে না। একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয়া হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বদলি নীতিমালাকে।

এ ব্যাপারে সংসদীয় কমিটির সভাপতি আফসারুল আমিন বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন ধরে গড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি বলেই তো পুলিশকে গ্রেপ্তার করতে হয়েছে। দুদক তদন্ত করছে। বদলির বিষয়ে তিনি বলেন, রেজুলেশনে সব ঠিক ছিল। কিন্তু শেষ লাইনে মন্ত্রণালয় চাইলে কাউকে দপ্তরে রাখতে পারবে- এই ধারা দিয়ে সব শেষ করে দিয়েছে। একাধিক সভায় শিক্ষা সচিবকে স্পষ্ট করে বলেছি বিভিন্ন দপ্তরের একই কর্মকর্তা যুগের পর যুগ চাকরি করার কারণে তারা নানা ধরনের সিন্ডিকেট তৈরি করে। এটা ভাঙার দরকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও তা ভাঙা হয়নি।

সূত্রমতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন অধিদপ্তর, প্রকল্প, ঢাকাসহ ১০টি শিক্ষাবোর্ড, এনসিটিবি, নায়েম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ব্যানবেইস, অবসর বোর্ড, কল্যাণ ট্রাস্টসহ বিভিন্ন দপ্তর এবং ঢাকার কলেজগুলোতেও এসব কর্মকর্তারা যুগ যুগ ধরে চাকরি করছেন। তারাই সেবা না করে ঘুষ-দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। টিআইবি’র অনুসন্ধানেও শিক্ষাখাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্যে সামনে এসেছে। শিক্ষক নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাখা খোলার অনুমতি, জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তি, সার্টিফিকেট সত্যায়ন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের অনুমতিসহ নানা কাজে সিন্ডিকেট গড়ে তুলছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে সেবাপ্রার্থীরা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কাজ করতে পারেন না। সব মিলিয়ে ঘুষের আখড়ায় পরিণত হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আরো অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষামন্ত্রী নিজেকে ‘ক্লিন ইমেজে’ রাখলেও তার ডানে-বামে ঘুষের হাট বসান এসব কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন প্রশাসনিক পদে থাকা এসব কর্মকর্তা দুর্নীতির এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা। প্রভাবশালী সেবাপ্রার্থীদের কাছে ঘুষ দাবি করে মাঝে মধ্যে দু-চারজন বিপাকেও পড়লেন শাস্তি কেবল বদলি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদন্ত করেও প্রমাণ মেলার পর বদলি হয়নি এমন কর্মকর্তা। তবে বেশিরভাগই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগে আতঙ্কে আছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরজমিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়েও এমন চিত্রই চোখে পড়েছে। সবার মধ্যে অস্থিরতা। একই চিত্র ছিল শিক্ষাভবন, ডিআইএ ও শিক্ষাবোর্ডগুলোতে। অনেকেই ভয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। একটি দপ্তরের একডজন একসঙ্গে ছুটিতে গেছেন।

মাউশির তথ্য অনুযায়ী শিক্ষাভবনে ৭০ জন কর্মকর্তা এক যুগের বেশি সময় ধরে কর্মরত। এরমধ্যে আছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের শারীরিক শিক্ষা শাখার একজন উপ-পরিচালক। শিক্ষা ক্যাডারে এই শিক্ষক ঢাকায় আছেন ১৮ বছর। তৎকালীন ঘুষের মধুর হাঁড়ি ডিআইএ সহকারী পরিদর্শক হিসেবে ঢাকায় পদায়ন শুরু, এরপর একদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাননি। ২০০৯ সাল থেকে শারীরিক শিক্ষা উপ-পরিচালক হিসেবে বহাল আছেন। মাঝখানে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও একটি প্রকল্পে। ভাগ্যবান যাকে বলে। প্রফেসর হওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী তার এই পদ ছেড়ে দেয়ার কথা। কিন্তু ছাড়েননি। মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বিভাগের উপ-পরিচালক-২ এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার। ঢাকায় আছেন ২০০২ সাল থেকে। ১৬ বছরে তার একদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হয়নি। তারও ডিআইএ সহকারী পরিচালক পদায়ন শুরু। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির একান্ত সচিব, মাউশির উপ-সচিব, সহকারী পরিচালক হিসেবে ১৬ বছর চাকরি করেছেন। জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলো পরিদর্শন করার সময় তার বেশ দুর্নাম রয়েছে। মাউশির উপ-পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন সরকার রয়েছেন প্রায় সাত বছর ধরে।

আইন কর্মকর্তা আবুল কাশেম ২০০৪ সাল থেকে ও সহকারী পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) মো. সাইফুল ইসলাম রয়েছেন ২০০৫ সাল থেকে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরী ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ বোর্ডেই আছেন। ঢাকা বোর্ডে সবচেয়ে দীর্ঘদিন প্রায় দেড় দশক ধরে কর্মরত আছেন উপ-সচিব ফজলে এলাহী। উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাসুদা বেগম ২০০৯ সাল থেকে এখনো কর্মরত আছেন। দীর্ঘদিনের তালিকায় আরো আছেন কলেজ পরিদর্শক আশফাকুস সালেহীন, বিদ্যালয় পরিদর্শক মাইনুল হোসেন, উপ-কলেজ পরিদর্শক অদ্বৈত কুমার। আর পরিদর্শন নিরীক্ষা অধিদপ্তরে ১৭ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে বদলির সুপারিশ করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু তাদের অনেকেই এখনো বহাল আছেন। যে ক’জনকে বদলি করা হয়েছে, তারা তুলনামূলক প্রাইজ পোস্টিং পেয়েছেন। ঘুরে ফিরে একযুগের বেশি সময় ধরে ঢাকায় সুবিধাজনক পদে থাকা আরো কর্মকর্তারা হলেন- মাদরাসা বোর্ডের রেজিস্ট্রার, কারিগরি বোর্ডের বিজয় কুমার ঘোষ, মাউশির আইন কর্মকর্তা আবুল কাশেম, সহকারী পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) মো. সাইফুল ইসলাম, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের চারজন, এনসিটিবি’র অধ্যাপক আবদুল মজিদসহ আরও ২৫ কর্মকর্তা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ বিভিন্ন দপ্তর, প্রকল্প, শিক্ষাবোর্ডে শিক্ষার ঘুষের হাটের ফেরিওয়ালারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষাবোর্ড, মাউশি, এনসিটিবি, নায়েম, রাজধানীর সরকারি কলেজ প্রকল্পে ঘুরে ফিরে থাকেন। শিক্ষা ক্যাডারে তারাই চেনা মুখ। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে যোগ দিয়ে অতিরিক্ত সচিব হলেও অন্যত্র বদলি হন না। তারাই শিক্ষা প্রশাসনে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।

এব্যাপারে মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর মাহাবুবুর রহমান বলেন, আমি মহাপরিচালক হিসেবে নতুন যোগ দিয়েছি। এ বিষয়টি আমি অবগত তাই আমি সচেতন। এখানে আগে কি হয়েছে সেটার দায় আমি নিবো না, কিন্তু অন্যায় করে কেউ ছাড় পাবে না সবাইকে এটি প্রকাশ্যে বলে দিয়েছি। তিনি বলেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে আছেন, তাদের ব্যাপারে খবর নেবো। আর মন্ত্রণালয় যদি এ উদ্যোগ নেয় তবে অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি আইকে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, শিক্ষা ক্যাডারদের মূল কাজই শিক্ষকতা করা। প্রশাসনিক কাজ করার কথা বলে যুগের পর যুগ ক্লাসের বাইরে থাকা উচিত বলে মনে করি না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পদায়ন, সংযুক্তি বা ডেপুটেশনের ক্ষেত্রে রোটেশন প্রথার সুপারিশ করেন তিনি। তাহলে দীর্ঘদিন ধরে পাঠদানের বাইরে থাকার সুযোগ হবে না।

সৌজন্যে: মানবজমিন

আপিলে যাবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিকে বৃহস্পতিবারও ছুটি - dainik shiksha আপিলে যাবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিকে বৃহস্পতিবারও ছুটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় - dainik shiksha হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে - dainik shiksha সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড - dainik shiksha মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নির্মিত তাঁবু গুটাতে কলাম্বিয়া শিক্ষার্থীদের অস্বীকৃতি - dainik shiksha ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নির্মিত তাঁবু গুটাতে কলাম্বিয়া শিক্ষার্থীদের অস্বীকৃতি শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ - dainik shiksha শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি - dainik shiksha সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041029453277588