শিক্ষা পণ্যের বিশ্বায়ন - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা পণ্যের বিশ্বায়ন

ড. মীজানুর রহমান |

শিক্ষা অবশ্যই মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে এবং মানুষকে বুদ্ধিমান করে তোলে। বুদ্ধিমান হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি দ্রুত পরিবর্তিত কোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেন। বর্তমানে শিক্ষাকে একটি পণ্য হিসেবে দেখা হয়। শিক্ষা যদি একটি পণ্য হয়, তাহলে শিক্ষা নামক পণ্যের একটি সংজ্ঞা দিতে হবে। পণ্য হচ্ছে তাই, যা মানুষের কাজে লাগে। মার্কেটিং-এর দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, পণ্য হচ্ছে ক্রেতার সমস্যা সমাধানের উপায়। পৃথিবীতে একসময় গুরুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। অর্থাত্ একজন মানুষ প্রাকৃতিকভাবে কোনো না কোনোভাবে শিক্ষিত হলেন, পরে তিনি তাঁর আশেপাশের মানুষদের শিক্ষা দিতেন। ওই শিক্ষিত ব্যক্তি আরও উচ্চপর্যায়ে উপনীত হলে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষজন তাঁর কাছে শিক্ষা অর্জনের জন্য আসতো। তিনি জ্ঞান বিতরণ করতেন। অ্যারিস্টটল কিংবা প্লেটোর আমলে এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। বিষয়টি এমন যে, কেউ একটা কিছু শিখলেন এবং সমাজের উপকারে সেই শিক্ষায় অন্যদের দীক্ষিত করলেন।

বর্তমানে শিক্ষার সঙ্গে অর্থের যোগ মুখ্য হয়ে উঠছে। এখনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা অর্জন একেবারে ফ্রি। শিক্ষিত মানুষের মৌলিক অধিকার বিবেচনায় রাষ্ট্র শিক্ষার সব খরচ বহন করে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। রাষ্ট্র যখন শিক্ষা খরচ পুরোটা বহন করতে পারছে না, তখন সমাজে ভিন্ন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। অর্থাত্ সমস্যার সমাধান করতে অনেকে এগিয়ে আসছে। ফলে বেসরকারিভাবে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। বেসরকারি ব্যবস্থা সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি ব্যবস্থায় বিনা স্বার্থে কেউ কোনো কাজ করেন না। তাদের প্রধান লক্ষ্য মুনাফা অর্জন করা। মুনাফা অর্জন না করে কেউ টিকে থাকতে পারবে না। আর মুনাফা আসে মূল্য থেকে। মূল্য নির্ধারণ করলেই কেবল মুনাফা আসবে। কাজেই এই দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা অবশ্যই একটি পণ্য এবং ভালোমানের লাভজনক পণ্য। দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে আমরা যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বা প্রযুক্তি ক্রয় করি, তেমনি শিক্ষাও একটি ক্রয়যোগ্য পণ্য। বর্তমানে এটাকে কেউ ফ্রি দিবে না, কিনতে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবসায়কে কেবলমাত্র মুনাফা অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত করবো কিনা। অনেক শিক্ষা ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা ক্রেতাদের নানাভাবে ফাঁকি দিচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটি, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনাখরচে কিছু পড়ানো হয় না। পৃথিবীর ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি পড়ানো হয়, কিংবা পুরো খরচ সরকার বহন করে, এমন নজির নেই। সেখানেও শিক্ষা কিনতে হয়। ব্রেন ড্রেইন আসলে খুব সনাতনী ধারণা। বলা হয়ে থাকে, দেশের মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে মেধা পাচার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আগে মনে করা হতো, আমাদের দেশের একজন ভালো বিজ্ঞানী আমেরিকায় চলে গেলেন, এতে দেশ বঞ্চিত হলো, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। ওই বিজ্ঞানী আমেরিকায় গিয়ে কিছু আবিষ্কার করলেন, ঠিক তার পরদিন বাংলাদেশের লোকজন তা পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে মেধা আর চলে যায় না; আর যাওয়ার সুযোগও নেই। গবেষণাগারে ও গবেষকদের মান অর্জন করা গেলে ঢাকায় বসেই একই মানের গবেষণা করা এখন অসম্ভব নয়। একজন ব্যক্তি বিদেশ চলে গেলেন, আর এতে দেশের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ আমাদের গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ল্যাবরেটরিতে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করার মত অর্থ আমাদের নেই, প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই। কাজেই গবেষণার জন্য বাইরে যেতেই হবে। আমাদের একজন গবেষক যখন নাসার মতো জায়গায় কাজ করেন তখন তাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে কী কাজ করানো যেতে পারে? তিনি এখানে এসে কী করবেন। এটাই আমাদের বাস্তবতা।

আমরা এখন দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু ব্যবহার করছি, তার কোনো কিছুই আমাদের উদ্ভাবন নয়। আমরা যদি সবাইকে ভালো সুযোগ, ল্যাবরেটরির সুবিধা দিতে পারতাম, তাহলে অনেকে গবেষণা এখানেই করতে পারত। তাহলে ঠিক ছিল। কিন্তু তা নেই। কাজেই আমাদের প্রচুর শিক্ষার্থীদের বিদেশ যেতে হবে এবং যাওয়ার দরকার রয়েছে। বিদেশ গিয়ে ফিরে না আসলেও কিছু যায় আসে না। বরং সেখানেই কাজ করুক। কেননা আমরা জনশক্তি রপ্তানির ব্যবস্থা রেখেছি। কেউ যদি বিদেশে পড়াশোনা শেষে নিজের কর্মসংস্থান করতে পারেন তাহলে ভালো। সৌদি আরবে ৫০ জন কর্মী পাঠানোর চাইতে কিং ফয়সাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক পাঠাতে পারলে বরং তিনি অনেক বেশি রেমিটেন্স পাঠাবেন। আমাদের একজন শিক্ষার্থী যদি বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে সে লেখাপড়া শিখে বিদেশ থেকে যাক, সমস্যা নেই। আমরা কেন বিদেশিদের ডেকে নিয়ে এসে এখানে পড়াবো। এগুলো পুরাতন ধারণা।

যেখানে যে পণ্য ভালো পাওয়া যাবে, ক্রেতারা সেখান থেকে কিনবে। শিক্ষারও একই অবস্থা। তবে শিক্ষার তো মানবিক মূল্যাবোধ থাকতেই হবে। আমরা যে যাই পড়ি না কেন, সেখানে যেন মানবিক মূল্যবোধকে বাদ দেয়া না হয়। বিশ্বের কোথাও কেবলমাত্র সায়েন্স কিংবা ডাক্তারি পড়ানো হয় না। সেখানে সবাইকে কলা ও সমাজবিজ্ঞানও পড়তে হয়। আমাদের দেশেও সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য অনেক বিষয়ের উপর জোর দেয়া হচ্ছে। হেকেপ প্রজেক্ট-এর আওতায় বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। বর্তমানে বিজ্ঞান আরো প্রসারিত হচ্ছে। কম্পিউটার সায়েন্স-এর ভবিষ্যত্ কী হবে? ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক সায়েন্স চলে এসেছে। কম্পিউটার ভবিষতে কেউ হয়ত ছুঁয়েও দেখবে না। টাইপ করার দরকার হবে না। মুখের কথা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্পোজ হয়ে যাবে। কোনো প্রযুক্তিই সর্বশেষ প্রযুক্তি নয়। বর্তমানে শিক্ষা পণ্যের বাজারে প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি বড় সমস্যা। যারা ছেলে-মেয়ের জন্য পড়াশুনার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না করে রাত জেগে ইন্টারনেটে প্রশ্নপত্র খোঁজেন এমন অপরাধী অভিভাবকদের কঠোর শাস্তি দেয়া দরকার। আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নিতেই হবে। চাহিদা ও সরবরাহ দুইদিক থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যাবে না।

লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029661655426025