শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর রংপুর সার্কেলের নীলফামারী কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহেরের বিরুদ্ধে কাজ না করেই প্রায় ১০ কোটি টাকার বিল প্রদান এবং নিজের দুই ভাইকে দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ করিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা জানাজানি হলে পুরো ঘটনা তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ার প্রতিবেদন দাখিল করার পর দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে চার কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলির আদেশ দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. রাহেদ হোসেনকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি রংপুরে এসে পুরো ঘটনা তদন্ত করে অভিযুক্তদের জবানবন্দি গ্রহণ করে। তদন্ত কমিটি সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহেরের বিরুদ্ধে কাজ না করে কোটি কোটি টাকা বিল প্রদান করার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে পুরো ঘটনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মেনহাজুল হক, রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুল হক, নীলফামারীর সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের লালমনিরহাটের উপসহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের আকন্দকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের অনত্র বদলি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মেনহাজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিসহ চারজন প্রকৌশলীকে রংপুর সার্কেল থেকে অনত্র বদলি করার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও আর কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে দেয়া লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের রংপুর সার্কেলের অধীনে দিনাজপুর জোনের আওতাধীন নীলফামারী জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের ২০২১ অর্থবছরে নীলফামারী জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মান ও সংস্কারসহ বিভিন্ন কাজের দরপত্র আহবানের পর কার্যাদেশ দেওয়ার ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ সম্পন্ন দেখিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকার অগ্রিম বিল প্রদান করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয় সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের তার স্বজন ও সিন্ডিকেট তৈরী করে নিজেই অনেক কাজ বেনামে করে বিল উত্তোলন করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহেরের দুই সহোদর কালাম ও আলমকে দিয়ে ঠিকাদারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে কাজ কিনে নিয়ে তারাই ঠিকাদারি করছেন। শুধু তাই নয় বিভিন্ন কাজের কার্যাদেশের আগের তারিখ দিয়ে কাজের অগ্রগতি দেখিয়ে বিল প্রদানের নজীরবিহীন অনিয়মও করছেন তারা।
যেসব কাজ না করেও অগ্রিম বিল প্রদান করেছে সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র ও তার বিরুদ্ধে জমা দেয়া লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের রেজিস্ট্রার ও প্রোগ্রেস রিপোর্ট পরীক্ষা করলেই পাওয়া যাবে সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের এবং তার ভাইয়েরা কাজ না করে প্রায় ১০ কোটি টাকা অগ্রীম বিল উত্তোলন করেছেন। প্রমাণস্বরূপ নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে এ বছরের ২৪ জুন কিন্তু প্রোগ্রেস রিপোর্টে ৩০ জুন পর্যন্ত এ কাজটির অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৪৫ ভাগ। অর্থাৎ কার্যাদেশের মাত্র ৫ দিনের মধ্যে প্রোগ্রেস ৪৫ ভাগ দেখিয়ে ওই কাজটিতে ৬৫ লাখ টাকা বিল দেয়া হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মেসার্স কারিব এন্টারপ্রাইজের নামে এ কাজটি করছেন সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের নিজেই। তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজ কিনে নেন। একইভাবে জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয় ২৭ জুন ২০২১ তারিখে। এই ২৭ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দুই দিনের ব্যবধানে ২৭ ভাগ কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ৩০ জুন ৩১ লাখ টাকা বিল প্রদান করা হয়।
একইভাবে ২০১৯-২০ সালের এক্সটেনশন অব নন গভর্নমেন্ট বিল্ডিং প্রকল্পের আওতায় ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের কার্যাদেশে সেখানকার বিল্ডিংয়ের পুরাতন ছাদ ভেঙে নতুন ছাদ নির্মাণের মাধ্যমে উর্ধমুখী সম্প্রসারণ করার কথা বলা হলেও ছাদ না ভেঙেই পুরাতন ভবনের ওপরে ঊর্ধমুখী ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সেটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এই কাজটিও সহকারী প্রকৌশলী আবু তাদের সিন্ডিকেট করেছেন এবং দরপত্র মূল্যের ৭১ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করেছেন। কাজটির মূল ঠিকাদার আবীর এন্টারপ্রাইজ।
জলঢাকার চেরেঙ্গা ঝারপাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কাজটির কার্যাদেশ দেয়া হয় ১০ মে ২০২০ তারিখে। কিন্তু সেটি দীর্ঘদিনেও কাজ হয়নি। কিন্তু চলতি বছরের ১ জুন থেকে ৩০ জুনের মধ্যে হঠাৎ করেই ২০ ভাগ কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ৩২ লাখ টাকা বিল প্রদান করেছেন সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের।
একই প্রকল্পের অধীনে সদর উপজেলার ফকিরগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসার ভবন নির্মাণকাজের কার্যাদেশ দেয়া হয় এ বছরের ১০ জুন। কিন্তু কার্যাদেশের ১০ দিন আগে দেখানো হয়ছে কাজ শুরু। ১ থেকে ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত ২৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে মেসার্স তোতা এন্টারপ্রাইজের নামে ১৯ লাখ ৯৭ হাজার বিল দেন আবু তাহের। এই কাজটিও আবু তাহের নিজ সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালনা করছেন, ওই কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স তোতা এন্টারপ্রাইজ।
যে ১৯টি কাজ ঠিকাদারদের কাছ থেকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সামান্য লাভ দিয়ে ক্রয় করে সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের ও তার ভাই আলম, কালাম ও আত্মীয় স্বজনরা করছেন, সেগুলো হলোÑ তিন হাজার স্কুল প্রকল্পের আওতাধীন সাতপাই উচ্চবিদ্যালয়, সৈয়দপুর, তিন হাজার স্কুল প্রকল্পের আওতায় ডোমার মহিলা কলেজ, ডোমার, আইসিটি কলেজ নীলফামারী মডেল কলেজ (সৈকত এন্টারপ্রাইজ নামে প্রক্রিয়াধীন), আইসিটি কলেজ প্রকল্পের আওতায় জটুয়াখাতা উচ্চবিদ্যালয়, ডিমলা, কিশোরীগঞ্জ মডেল উচ্চবিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ, সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতাধীন উত্তর ভোগডাবুড়ি উচ্চবিদ্যালয়, ডোমার, ৭০১৬ মাগুড়া কলেজ, কিশোরগঞ্জ,চ্যারেংগা ঝাড়বাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়, জলঢাকা, ৭০১৬ দুবাছড়ি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ৭০১৬ প্রকল্পের আওতায় চিলাহাটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ডোমার নীলফামারী মহিলা কলেজ, নীলফামারী সরকারি কলেজ (কলেজ ফান্ড), চিলাহাটি সরকারি কলেজ ও ডোমার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
বিল পরিশোধেও তাহের সিন্ডিকেট বেপরোয়া। বিল পরিশোধের বিষয় আসলেই আবু তাহের ও তার ভাই এবং আত্মীয়-স্বজনরা যে কাজ করেছেন, সেই বিলগুলো আগে পরিশোধ করা হয়। তার পর অন্যান্য ঠিকাদারদের আনুপাতিক হারে বিল ভাগ করে দেয়া হয়। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ এই দুই অর্থবছরের নীলফামারী জেলার শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তরে প্রাপ্ত বরাদ্দ ও ঠিকাদারদের বিল পরিশোধের রেজিস্ট্রার এবং সরেজমিন তদন্ত করলেই এই অনিয়মের পুরো বিষয়টি বেরিয়ে আসবে বলেও অভিযোগে বলা হয়।
এদিকে সার্বিক বিষয়ে জানতে সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেন।