শিক্ষা হোক শিশুবান্ধব - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা হোক শিশুবান্ধব

মো. সিদ্দিকুর রহমান |
শেখ রাসেল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা অঞ্চলের ধানমন্ডিতে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৮ অক্টোবর ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখেন ‘রাসেল’। এই নামকরণে মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শৈশব থেকে দুরন্ত প্রাণবন্ত রাসেল ছিলেন পরিবারের সবার অতি আদরের। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। ভাই-বোনের মধ্যে অন্যরা হলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সংগঠক শেখ কামাল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা শেখ জামাল এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ শেখ রেহানা। শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। 
 
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ঢাকায় অবস্থানরত তার পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করেছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অপশক্তি। বাদ পড়েনি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও। শিশু রাসেল সেই ভয়ঙ্কর সময়ে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়েছিলো সেন্ট্রি পোস্টের পেছনে। পরিবারের সবাইকে হত্যা করে খুনিরা খুঁজতে থাকে তাকে। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়েও যায়। ভয় পেয়ে রাসেল কাঁদতে থাকে আর বলে, ‘আমাকে মেরো না, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও।’  শিশু রাসেল তখনো জানত না ঘাতকরা তার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলেছে। কান্না শুনে ঘাতক তাকে বলে, চল, তোর মায়ের কাছে। তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায় দোতলায়। সেখানে বাবা-মায়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে চমকে ওঠে রাসেল। কাঁদতে থাকে। নিষ্ঠুর ঘাতকের দল মায়ের কাছে নিয়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় শিশু রাসেলের ছোট্ট শরীরটা। নিথর শরীর আছড়ে পড়ে মায়ের শরীরে। এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
 
বেদনা ও দুঃখের স্মৃতি আজ আমাদের মাঝে হাহাকার হয়ে ভেসে আসে শিশু রাসেলকে মনে হলে। প্রতিদিন শিশুহত্যা ও শিশু নির্যাতনের খবর দেখলে ভাবি, মানুষরূপী নরপিশাচরা কেনো কঠোর যন্ত্রণাময় শাস্তি পায় না? ছোট্ট শিশু রাসেলের তো বেঁচে থাকার কথা ছিলো। এ অবুঝ শিশুটি কী অন্যায় করেছিলো? রাসেলের বেঁচে থাকার আকুতি কি বাংলার আকাশ-বাতাসকে স্তব্ধ করেনি? কেনো হানাদারদের হৃদয়ে শিশুর প্রতি ভালোবাসার স্থান হয়নি? আজ শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাসেলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা জাগ্রত করতে হবে। সকল শিশুর জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
 
ধর্ষণে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করা হয়েছে। অথচ হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে শিশুর ওপর মাত্রাধিক বই-খাতার বোঝা দূর করার বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নীরব। মাত্রাতিরিক্ত বই-খাতা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই, শিশুদের জন্য উপবৃত্তি, মিড ডে মিল ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়নসহ শিশুদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ১ম থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত প্রচলিত পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালুর নির্দেশ দিয়েছেন।  শিক্ষায় উন্নত দেশ ফিনল্যান্ডে শিশুদের পরীক্ষা ও বাড়িতে পড়ার কোনো চাপ নেই। সেখানে বিদ্যালয়ই তাদের সব পড়াশোনার স্থান। পরীক্ষা ব্যবস্থা, বাড়িতে পড়ার চাপ আমাদের দেশে আদিকাল থেকেই। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক ও অভিভাবক বাড়িতে শিশুর পড়াশোনা না করা এবং পরীক্ষাবিহীন শিক্ষার কথা ভাবতেও পারেন না।
 
উন্নত বিশ্বের আদলে বিদ্যালয়ই হোক শিক্ষার কেন্দ্র, জ্ঞান অর্জন হোক শিক্ষার লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে সর্বাগ্রে শিক্ষক সংকট শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। সব শিশুর জন্য অভিন্ন কর্মঘণ্টা, বই, মূল্যায়ন ব্যবস্থা আজকের দিনে কাম্য। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের মতো শিক্ষকদের মর্যাদা, বেতন ও জবাবদিহিতা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষায় বাজেটের স্বল্পতা রেখে, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখে অগ্রসর হওয়া যাবে না। এ জন্য আমলাতান্ত্রিক মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নতির মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে।
 
কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে অভিন্ন বই, কর্মঘণ্টা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তুলতে হবে। অবিলম্বে ইউআরসির মাধ্যমে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরেও আমাদের দেশের শিশু শিক্ষাব্যবস্থা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণাধীন চলেছে। সকল মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা চলছে ক্যাডারবিহীন। এর ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এর অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ কাজে আসে না। শিশু শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মেধাবী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ জনবল। প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক পদে মেধাবীরা নিয়োগ পেয়ে আসছে। পদোন্নতির সুব্যবস্থা না থাকায় তাদের এ পেশায় আকৃষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৮০ শতাংশ প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি। বাকি ২০ শতাংশ প্রশিক্ষণবিহীন উন্মুক্ত। তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণবিহীন হওয়ায় তৃণমূলে বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা হোঁচট খাচ্ছে। ২০২৩ খ্রষ্টিাব্দরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালায় সহকারী উপচেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী ইন্সটাক্টর ইউ আর সি পদে পদোন্নতি সুযোগ রাখা হয়নি। এ পেক্ষাপটে শিশু রাসেলের জন্মবার্ষিকীতে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের প্রত্যাশা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মচারী নিয়োগবিধি অবিলম্বে বাতিল করা হোক। সহকারি শিক্ষকের পদকে এন্টি ধরে শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে স্বতন্ত্র প্রাথমিক ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করে, শিশু বান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলা হোক।     
 
আসুন, আজ বিবেকবান মানুষ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ আপামর জনসাধারণ রাসেলের কথা স্মরণ করে এদেশের শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে শপথ গ্রহণ করি। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর কোনো শিশুরা যেন অত্যাচার ও বঞ্চনার শিকার না হয়। অসহায়ত্বের মাঝে যেনো তাদের মরণ না হয়। শিশু রাসেল আজ সব শিশুর প্রতীক। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। এ প্রত্যাশায় শিশু রাসেলের স্মৃতিচারণে বলতে চাই, শুদ্ধচিত্তে দৃঢ় বিবেক নিয়ে দৃপ্তভাবে শিশুর অধিকার নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সৃষ্টি হোক। এতে শিশুদের পাশাপাশি প্রিয় রাসেলের আত্মাও শান্তি পাবে।
 
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ  

 

 

 

সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.030424118041992