শিশুরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আজকের শিশু দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারা একদিন বড় হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। জন্ম দেবে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যপূর্ণ অধ্যায়ের। তাই শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা তথা সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শিশুদের শিক্ষিত হতে হলে শিশুর পাঠে মনোযোগ বৃদ্ধি জরুরি। আবার এ কথাও সত্যি যে পাঠে মনোযোগ বা পড়াশোনা করতে শিশুদের যে অনেক ভালো লাগে সেটা কিন্তু নয়। এমন শিশু খুঁজে পাওয়া দুর্লভ যে নিজ থেকে পাঠে মনোযোগী হয়। আর শিশুর মতের বাইরে যদিও তাকে পাঠে বাধ্য করানো যেতে পারে, কিন্তু পড়ালেখায় তার মনোযোগ আনা যাবে না- এটা মোটামুটি হলপ করে বলা যায়। শুক্রবার (১৩ মার্চ) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, আবার দেখা যায় খুব সহজ একটি পড়া শিশুরা মনে রাখতে পারছে না, একটু পরেই তারা ভুলে যাচ্ছে। মনোযোগ না দেয়ায় আর সহজে ভুলে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশুরা। অথচ প্রতিটি শিশুই সম্ভবনাময়, প্রতিটি শিশুই অনন্য। সুশিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু এটা কোন সহজ কর্ম নয়। আমাদের দায়িত্বশীল আচরণের জন্য একটি শিশুর জীবন সাফল্যের আলোকে উদ্ভাসিত হতে পারে। আবার আমাদের দায়িত্বহীন আচরণ বা অজ্ঞতার কারণে একটি শিশুর সারাটা জীবন গহীন অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হতে পারে। তাই এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। যে পদ্ধতি/কৌশলগুলো অনুসরণ করলে শিশুকে পাঠে মনোযোগী করা যাবে সেগুলো এবার জেনে নেয়া যাক।
আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান : শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ- প্রয়োজন আনন্দঘন পরিবেশ। আনন্দঘন পরিবেশে শিশু নিজেকে নিজের মতো করে তৈরি করার সুযোগ পায়। শিশুর মন হলো মুক্ত বিহঙ্গের মতো, কোনো কিছুতেই বাধ মানতে চায় না। তারা নীড় বাঁধতে চায় আকাশে। আর তারা দীপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে নতুন সভ্যতার দিকে- এটা আমাদের প্রত্যাশা। শিশুর শেখার ধরন বুঝে তার ধারণ-ক্ষমতা অনুযায়ী আনন্দঘন ও শিশুবান্ধব পরিবেশে তাকে শিক্ষা দিতে হবে। শিশুর শেখার ধরন অনুযায়ী তাকে শিক্ষা দিতে পারলে সে শিশু একদিন কালজয়ী বিশেষজ্ঞ হতে পারবে। ভীতিহীন পরিবেশে, আনন্দের মাঝেই সকল শিশু শিখতে চায়। কঠোর শাসন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর শিক্ষা জীবনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়। মনের আনন্দই শিশুর অন্তর্নিহিত শক্তির মূল উৎস। তাই আনন্দঘন ও শিশুবান্ধব পরিবেশ ছাড়া শিশুর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো অসম্ভব। শিশুদের জন্য আনন্দমূলক শিক্ষা (Joyful Learning) নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। শিশুর শৈশব কলুষমুক্ত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত না হলে তার সোনালী ভবিষ্যৎ কিছুতেই আশা করা যায় না।
শিশুর বুদ্ধিমত্তার ধরন চিহ্নিতকরণ এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া : সব শিশু একভাবে শেখে না। একেক শিশুর শেখার ধরন যেমন একেক রকম তেমনি একেক শিশুর বুদ্ধিমত্তাও একেক রকম। কেউ নাচ-গানের মাধ্যমে শিখতে চায়, কেউ খেলার মাধ্যমে শিখতে চায়, কেউ গল্পের মাধ্যমে শিখতে চায়, কেউ একাকী শিখতে চায়, কেউ দলে শিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কেউ যুক্তি খাটিয়ে শিখতে চায়, কারও প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের প্রতি আকর্ষণ বেশি, কেউ অনুকরণ বা অনুসরণ করে শেখে, উপকরণ (ছবি, চার্ট, মডেল, বাস্তব জিনিস) ব্যবহার করে শেখালে কেউ বেশি মনে রাখে, কেউ যুক্তি খাটিয়ে শিখতে চায় ইত্যাদি। কাজেই সব শিশুকে যদি একভাবে শেখাতে চাওয়া হয় তাহলে সেটা তাদের জন্য বোঝা ও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। কাজেই শিশুর বুদ্ধিমত্তার ধরন চিহ্নিত করে যে শিশুর আগ্রহ বা প্রবণতা যেদিকে বেশি তাকে সেভাবে শেখালে সে পাঠে অধিকতর মনোযোগী হবে। ফলে শিশু তাড়াতাড়ি শিখতে পারবে এবং মনে রাখতে পারবে।
উপকরণ সহকারে পাঠদান করা : যে সব দ্রব্য বা জিনিসপত্র ব্যবহারের ফলে শিক্ষাদান বা শিখন-কার্য সহজ, আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক, কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয় তাকে শিক্ষা উপকরণ বলে। অর্থাৎ পঠন-পাঠনকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে তুলতে ইন্দ্রীয় সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি দিয়ে আলঙ্কারিক করা প্রয়োজন; এই আলঙ্কারিক সামগ্রীই হলো শিক্ষা উপকরণ। শিক্ষা উপকরণ ছাড়া মানসম্মত শিখন-শেখানো কার্যক্রমের কথা চিন্তাই করা যায় না। শিশুমন বৈচিত্র্যময়, তার শিখন চাহিদাও বহুমুখী। শিশুর জন্য শিখন হবে এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। তাই শিখন-শেখানো শিশুর কাছে চিত্তাকর্ষক হওয়া চাই; যাতে করে শিশুমনকে সহজেই নাড়া দেয়া যায়। শিশুর পরিচিত বস্তু, পরিচিত বিষয় বা ঘটনা এবং পরিচিত পরিবেশকে পাঠের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে শ্রেণী শিখন-শেখানোর সময় উৎকৃষ্ট উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কারণ জটিল ও বিমূর্ত বিষয়গুলোকে শিশুর কাছে সহজ ও আনন্দদায়ক করার জন্য উপকরণের বিকল্প নেই। আর এসব উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা হবে জীবন ঘনিষ্ঠ যা শিশুর নিজের, পরিবারের, সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
খেলার ছলে পড়ানো : খেলতে কোন শিশু-না ভালোবাসে। তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা সবকিছু খেলার উপকরণ আর খেলা নিয়ে। তাই এই খেলার প্রতি ভালোবাসা কাজে লাগিয়ে শিশুদের পড়াতে বসানো সহজ। খেলার ছলে যদি তাদের দরকারি পড়াটা শিখিয়ে বা আয়ত্ত করিয়ে দেয়া যায় তবে তা শিশুর কাছে চাপ মনে হবে না। তাদের ওপর এমন চাপ কখনোই দেয়া উচিত নয় যেন তারা খেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। তাদের খেলার ফাঁকে ফাঁকে পড়তে বসার অভ্যাস করাতে হবে। এতে তাদের পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং পড়ার প্রতি মনোযোগ বাড়বে।
গল্পের ছলে পড়ানো : গল্প শুনতে প্রত্যেক শিশুই ভালোবাসে। কোন কোন শিশু গল্প শুনে ঘুমায়, গল্প শুনে খায়, আবার অনেকে কান্নাও ছেড়ে দেয় গল্প শুনে। তাহলে পড়া কেন গল্পের মতো করে নয়! কাজেই পড়াগুলো অবশ্যই গল্পের মতো করে শিশুর কাছে উপস্থাপন করতে হবে। এতে শিশুর পড়ার আগ্রহ অনেক বেড়ে যাবে আর পাঠে মনোযোগ আপনা-আপনি চলে আসবে।
নিকট পরিবেশ থেকে এবং বাস্তবভিত্তিক উদাহরণ ব্যবহার করে শেখানো : শিশুদের শেখানোর ক্ষেত্রে আশেপাশের পরিবেশের বিভিন্ন জিনিস বা ঘটে যাওয়া ঘটনা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করলে শিশুরা বেশ আগ্রহী হয়। এতে কারা বইয়ের পড়ার সঙ্গে বাস্তবের একটা সমন্বয় ঘটাতে পারে। তখনই শিখন হয় জীবনঘনিষ্ট। ফলে শিখনে তারা আনন্দ পায়, একঘেয়েমি দূর হয় এবং পাঠে অধিক মনোযোগী হয়। তাছাড়া বাস্তবভিত্তিক উদাহরণ দিলে শিখন অপেক্ষাকৃত স্থায়ী হয়।
মাঝে মাঝে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া : শিশুর মন বৈচিত্র্য প্রত্যাশী। তারা সবসময় নতুনত্ব চাই, পরিবর্তন চায়। তাই মাঝে মাঝে শিশুদের বাইরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব। এতে করে শিশুদের মধ্যে বাড়ি ও বিদ্যালয়ের একঘেয়েমি দূরীভূত হয়। পড়াশোনায় শিশুর মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া তাদের জ্ঞানের পরিধিও বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই সুযোগ পেলেই শিশুকে বিভিন্ন আনন্দদায়ক, দর্শনীয়, গুরুত্বপূর্ণ বা ঐতিহাসিক স্থানে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া উচিত।
গণিত শেখাতে হবে শিশুদের প্রিয় বিষয়ের উদাহরণ দিয়ে : শিশুরা গণিতে যতটুকু ভয় পায় তার চেয়ে বেশি ভুল করে। কিছু কৌশল ব্যবহার করে সহজেই এই ভয় আর ভুল করা দূর করা যেতে পারে। আশেপাশের শিশুর প্রিয় বিষয় বা বস্তুর সাহায্যে উদাহরণ দিয়ে অতি সহজেই গণিতকে তার কাছে মজার বিষয় বানানো যায়। যেমন- তার খেলনার সংখ্যা কত, তাকে আরও কিছু সংখ্যক খেলনা দিলে মোট কতটি হবে? তার থেকে কিছু সংখ্যক নিয়ে গেলে বাকি কত থাকে- ইত্যাদি। এভাবে বস্তুনিরপেক্ষে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে বাস্তব, অর্ধবাস্তব উপকরণ ও গল্পের ছলে হাতে-কলমে গণিত শেখানো যেতে পারে। তাছাড়া উপরের শ্রেণীতে সমস্যাগুলো বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শিখিয়ে দেয়া উচিত। এতে করে শিশুর পাঠে মনোযোগ দিনদিন বৃদ্ধি পাবে।
গণিতের ধারণা দিতে বিভিন্ন পর্যায়ের উপকরণ ব্যবহার করা : গণিতের ধারণা দিতে তিন পর্যায়ের উপকরণ ব্যবহার করা প্রয়োজন। তিন পর্যায়ের উপকরণ ব্যবহার করলে শিশুদের কাছে গাণিতিক যে কোন বিষয়ের ধারণা স্পষ্ট করা সহজ হয়। কোন বিষয়ের ধারণা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রথমে বাস্তব উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। যেমন- কাঠি, পাতা, মার্বেল, পাথর, দাড়িপাল্লা, বাটখারা, বীচি, ফল ইত্যাদি। এছাড়া হাতের আঙ্গুল, শ্রেণীর শিক্ষার্থী, বেঞ্চ, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদিকে বাস্তব উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পরবর্তী সময়ে অর্ধবাস্তব উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। যেমন- ছবি প্রদর্শন, চার্টের ব্যবহার, বোর্ডে ছবি এঁকে ধারণা প্রদান ইত্যাদি। সবশেষে সংখ্যা/বস্তু নিরপেক্ষ উপকরণ ব্যবহার করতে হবে; যেমন- সংখ্যা-কার্ড, সংখ্যাবিষয়ক চার্ট, সংখ্যার মডেল ইত্যাদি ব্যবহার করা।
বৈজ্ঞানিক কিছু পরীক্ষা শিখিয়ে বিজ্ঞানের বই হাতে দেয়া : অনেক শিশুই সব বিষয়ে যুক্তি খাটিয়ে শিখতে চায়, সব কিছুর পেছনে কারণ খুঁজে- অনুসন্ধিৎসু মনোভাবাপন্ন। অনেক শিশু আবার এ রকম নয়। কিছু সংখ্যক শিশু বিজ্ঞান বিষয়টিকে অযথা ভয় পেয়ে থাকে। আর এই ভয় থেকে বাঁচার জন্য পড়া থেকে দূরে থাকে। ফলে আস্তে আস্তে মনোযোগও হারায়। তাই এই বিষয়ের পড়াও তাদের খুব একটা মনে থাকে না। বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বা মনোযোগ তৈরিতে বিদ্যালয়ে বা বাড়িতে শিশুদের উপযোগী কিছু বিজ্ঞানের বই রাখা এবং শিশুদের পড়তে দেয়া উচিত। মাঝে মাঝে বিজ্ঞানের কিছু পরীক্ষা করে দেখানো উচিত। এতে করে শিশুরা বিষয়টিতে মজা খুঁজে পাবে। কেননা শিশুরা নতুন কিছু আবিষ্কার করতে খুব পছন্দ করে। ফলে বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ জন্মাবে, আর তারা বেশ ভালোভাবেই পড়া মনে রাখতে পারবে।
উৎসাহ বা টোকেন প্রদান, তিরস্কার না করা : সবাই কাজের স্বীকৃতি পেতে পছন্দ করে- এমনকি শিশুরাও। যতটুকুই পারুক শিশুদের উৎসাহ প্রদান করতে হবে। যেমন- ভালো হয়েছে, তুমি তো অনেক পার, খাতায় Good, Very Good লিখে দেয়া ইত্যাদি। তাহলে তারা পরবর্তী সময়ে আরও ভালো করার জন্য সচেষ্ট হবে। অপারগ শিশুদের কখনো তিরস্কার করা যাবে না। এতে তাদের মধ্যে জড়তা এবং নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।
ইংরেজি উচ্চারণগত শুদ্ধতার চেয়ে অনর্গল বলার ক্ষমতাকে উৎসাহিত করা : ইংরেজি একটি বিদেশি ভাষা। এই ভাষা শেখার প্রতি শিশুদের সাধারণত বেশি ভীতি দেখা যায়। ইংরেজি ভাষা বলার শুরুতে উচ্চারণগত বা ব্যাকরণগত শুদ্ধতার চেয়ে অনর্গল বলার ক্ষমতাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত। কোন শিক্ষার্থী ইংরেজি কোন শব্দ বা বাক্য উচ্চারণগত বা ব্যাকরণগতভাবে ভুল করতেই পারে। কিন্তু এই ভুলটাকে প্রাধান্য দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়া যাবে না। তাকে আরও বেশি বেশি বলতে উৎসাহিত করতে হবে। পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে তার ভুলগুলো শুধরে দিতে হবে। শুরুতেই তাকে থামিয়ে দিলে সে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। ফলশ্রুতিস্বরূপ সে ইংরেজি বলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে।
শিশুদের সৃজনশীল কাজ প্রদান : শিশুদের শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের মেধাকে বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কাজ দেয়া যেতে পারে। এতে যেমন পাঠ্য বইয়ের একঘেয়েমি দূরীভূত হয় তেমনি শিশুর অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটে। নতুন কিছু সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় এবং পুনরায় একই ধরনের কাজে উৎসাহিত হয়। সৃজনশীল কাজে শিক্ষক কেবল সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করবেন। সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে শিশুরা পাঠে অধিক মনোযোগী হয়ে থাকে।
পুরস্কার দেয়ার কথা না বলা, আনন্দ দিয়ে পড়ানো : অনেকেই মনে করেন যে, শিশুদের পুরস্কার দেয়ায় কথা বললে তারা সহজে পড়া মুখস্থ করে। কিন্তু এটা একদিক থেকে যেমন ভালো অপরদিক থেকে তেমনি ক্ষতিকর একটি বিষয়। পুরস্কারের লোভে তারা পড়া তৈরি করে থাকে, এতে তারা পুরস্কারের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে- যা ভবিষ্যতে খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে। অন্যদিকে আনন্দ দিয়ে পড়তে পড়তে একসময় তারা সত্যি সত্যি পড়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়।
প্রতিযোগিতা নয় সহযোগিতা : শিশুদের পড়া নিয়ে অর্থহীন প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দেয়া ঠিক নয়। অনেক বাবা মা বিষয়টি বুঝতে চায় না। শিশুরা নিজেরা যদি কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করতে চায় তবে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া উচিত। শিশুরা যদি প্রতিযোগিতায় ভালো ফল করে তবে সে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়। আর যদি প্রতিযোগিতায় ভালো করতে না পারে তবে অনেক শিশু মন খারাপ করতে পারে। যদি শিশু প্রতিযোগিতায় ভালো করতে না পারে/পুরস্কার না-ও পায় সেক্ষেত্রে শিশুকে কিছুতেই তিরস্কার করা যাবে না। বরং তাকে আরও বেশি উৎসাহ দিয়ে তার মন-মানসিকতাকে আনন্দময় করে তুলতে হবে যাতে সে পরবর্তী সময়ে আরও ভালো করার জন্য উৎসাহিত হয়। তাকে বোঝাতে হবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাটাই বড় কথা। পুরস্কার পাওয়াটা মুখ্য নয়।
শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা : ভবিষ্যতের জন্য সুনাগরিক পেতে হলে আগামী প্রজন্মকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। সুশিক্ষিত জাতির জন্য সুশিক্ষা খুবই জরুরি। আর এই সুশিক্ষা নিশ্চিতের জন্য চাই শিক্ষার্থীর সুস্বাস্থ্য। প্রবাদ আছে, ‘স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল’। আমরা জানি, স্বাস্থ্য যদি ভালো না থাকে তবে উচ্চশিক্ষিত হয়েও, প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক হয়েও জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়া যায় না। তাই সবারই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত অত্যাবশ্যক। আর এ স্বাস্থ্য সঠিক রাখতে গেলে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, কিছু কিছু নিয়ম মেনে চলতে অভ্যস্ত করতে হবে। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে- স্বাস্থ্য ভালো থাকলে শিশু নিজ থেকেই পাঠে মনোযোগী হবে এবং লেখাপড়াও ভালো হয়। এজন্য পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুদের স্বাস্থ্যশিক্ষা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দেয়া জরুরি।
সবসময় পড় পড় না বলা : মনে রাখতে হবে, শিশুকে সব সময় পড়ার জন্য চাপ দেয়া যাবে না। বেশি চাপ দিলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। এতে শিশু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে এবং এক সময় বিরক্তিবোধ থেকে পাঠের প্রতি অনীহা আসতে পারে। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে শিশুকে পাঠে বসানো উচিত।
বই রাখতে হবে শিশুর হাতের নাগালে : শিশুকে পাঠে মনোযোগী করার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের পাশাপাশি পরিবারকেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। প্রতিদিন পারিবারিকভাবেও একটি নির্দিষ্ট সময় পড়ার অভ্যাস করতে হবে। বড়দের পড়তে দেখলে শিশুরাও পড়তে উৎসাহিত বোধ করে এবং শিশুর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। শিশুর বই রাখতে হবে হাতের কাছে- তার যখন ইচ্ছে তখন যেন পড়তে পারে। যেমন- বেডরুমে, ড্রয়িং রুমে, গাড়িতে, রিডিং-কর্নারে।
নতুন নতুন বই কিনে দেয়া : নতুন বইয়ের প্রতি সব শিশুরই আলাদা আকর্ষণ থাকে। পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য শিশুকে মাঝে মাঝে বইয়ের দোকানে বা পাঠাগারে নিয়ে যাওয়া উচিত এবং তার পছন্দ মতো বই কিনে দেয়া উচিত। নতুন বই পেলে শিশুর পড়ার আগ্রহ অনেক গুন বেড়ে যায়। বাবা-মা/অভিভাবকদের উচিত শিশুকে পড়ার জন্য উৎসাহিত করার নিমিত্তে নানা ধরনের সম্পূরক পঠন-সামগ্রী কিনে দেয়া। আবার পড়তে না পারার জন্য কখনও তিরস্কার করা যাবে না।
প্রতিটি শিশুর ওপরই আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রতিটি শিশুই অনন্য, প্রতিটি শিশুর মধ্যেই অসীম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আবার এ কথাও মনে রাখতে হবে প্রতিটি শিশুই স্বতন্ত্র ও আলাদা। আজকের এই শিশু আগামী দিনে কী হবে তা পূর্ব থেকে বলার কোন সুযোগ নেই। কাজেই কোন শিশুকে খাটো করে দেখা যাবে না। সব শিশুকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কোন শিশুকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। আমাদের কাজ হবে প্রতিটি শিশুকে পাঠে মনোযোগী করে তুলা এবং তাকে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ দিয়ে তার মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে আছে তার যথাযথ বিকাশ ঘটানো। প্রতিটি শিশু যেন তার সামর্থ্য অনুযায়ী সফলতার চরম শিখরে পৌঁছে এ হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : শরীফুল্লাহ মুক্তি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষা-গবেষক ও ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি)।