শিশুর ঘুম ও সকাল বেলার স্কুল - দৈনিকশিক্ষা

শিশুর ঘুম ও সকাল বেলার স্কুল

ইসরাত জাহান |

প্রবাদ আছে, ‘Early to bed and Early to rise, makes a man healthy, wealthy and wise.’ যার বাংলা অর্থ ‘সকাল সকাল শয়ন ও শয্যাত্যাগ মানুষকে স্বাস্থ্যবান, সম্পদশালী ও জ্ঞানী করে।’ প্রকৃত অর্থে সকাল সকাল শয্যায় গমন আমরা নগরবাসী অভিভাবকগণ শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা নিশ্চিত করতে পারছি? পারছি কি তাদের জন্য পরিপূর্ণ নিরাপদ ঘুমের ব্যবস্থা করতে? না তার কোনটাই পারছিনা। কারন, আধুনিক আলোকিত নগরায়ন রাতের বৈশিষ্ট্যকে পাল্টে দিয়েছে, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, কম্পিউটার-মোবাইল গেমস ইত্যাদি শিশুর পর্যাপ্ত ঘুমকে নিয়েছে কেড়ে। অন্যদিকে খুব সকালের বিদ্যালয় যাত্রা তাদের তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করছে। ফলশ্রুতিতে তারা পর্যাপ্ত/পরিমিত ঘুম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, ঢাকা মহানগরীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে দৈনিক কার্যক্রম শুরু সকাল ৭.৩০ মিনিটে। ৭.১৫ মিনিটে সমাবেশের জন্য দাঁড়াতে হয়। ফলে বিদ্যালয়ে আসতে হয় সকাল ৭টা থেকে ৭.১৫ এর মধ্যে। সকাল সকাল আধো ঘুমে, কখনো মা-বাবাদের কোলে চড়ে কোন রকমে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে এসে উপস্থিত হচ্ছে। দেরিতে ঘুমালে সকালে উঠতেও দেরি হবে এটাই স্বাভাবিক। এই অসস্পূর্ণ ঘুম এর পরিণতি যে শুধুই পড়ালেখায় অমনোযোগিতা তা কিন্তু নয়। এতে শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক মেধা বিকাশ বাধা গ্রস্থ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। আমেরিকান একাডেমিক অব সিøপ মেডিসিনের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল শিশুদের প্রয়োজনীয় ঘুমের কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, যেখানে, ০৩-০৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য দৈনিক ১০-১৩ ঘণ্টা এবং ০৬-১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ৯-১২ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করেছেন। কর্মময় এ জীবনে মা-বাবারা যেখানে অধিক রাত জাগেন, সেখানে শিশুদের যথাসময়ে ঘুমাতে যাওয়াটা একেবারেই অনিশ্চিত। তাছাড়া মা-বাবাদের অসচেতনতাও এর জন্য দায়ী। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পারিপাশির্^ক অবস্থার প্রেক্ষিতে দেখা যায় রাত ১২/১টার আগে কোন শিশু শিক্ষার্থী ঘুমাতে যায় না কিংবা ঘুমের জন্য পরিবারে অনুকূল পরিবেশ পায় না। এতে তারা ঘুমানোর জন্য আনুমানিক সময় পাচ্ছে ৬/৭ ঘণ্টা যা একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জন্য ও যথেষ্ট নয়।

ফলশ্রুতিতে, বিদ্যালয়গামী শিশু শিক্ষার্থীদের উপর যে প্রভাবগুলো পড়ছে তা হলো: তারা খুব সকালে অসম্পূর্ণ ঘুম নিয়ে বিদ্যালয়ে আসে, অনেকে নাস্তা না খেয়ে আসে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় শ্রেণী পাঠে তারা মনোযোগী হতে পারে না। অমনোযোগিতার কারণে সহপাঠীদের সঙ্গে সমভাবে পাঠে এগিয়ে যেতে পারে না, অনেক সময় শিক্ষকের নির্দেশনা সঠিকভাবে নিতে পারে না। শ্রেণীকক্ষে ঝিমানো ইত্যাদি। ফলে বিদ্যালয়ের প্রতি ধীরে ধীরে একটা অনীহা তৈরি হয়। এই অনীহা এক পর্যায়ে তাকে, স্কুল পালানোর প্রবণতা, অনুপস্থিতি এবং শেষে ঝরে পড়ার দিকে ধাবিত করে। তাছাড়া, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপস্থিত না হওয়ার কারণে তারা সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে পারে না। অন্যদিকে, ঢাকা মহানগরীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র পরিবার থেকে আসে যাদের অনেকেই তাদের সন্তানদের হাতে টিফিনের টাকা দিতে পারেন না। এতে একটা দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীটি ক্ষুধার্ত থাকে। ফলে সে শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যা করা যেতে পারে তা হলো, স্কুল টাইম পরিবর্তন করে ৭.৩০ এর পরিবর্তে সকাল ৯/৯.৩০টা থেকে স্কুল শুরু করা যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রতিটি বিদ্যালয়ে মিডডে মিল এর ব্যবস্থা করাযেতে পারে। যদিও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বিস্কিট বিতরণসহ মিডডে মিলের কার্যক্রম রয়েছে তবে তা সীমিতসংখ্যক বিদ্যালয়ে। দ্রুত মহানগরীর সকল বিদ্যালয়ে মিডডে মিলের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

খুব সকাল বেলার স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের উপরও কোন প্রভাব ফেলছে কিনা তা আমরা অনেকেই ভেবে দেখি না। বাস্তবতা হলো আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের ৬৪ শতাংশেরও অধিক শিক্ষকই হলেন নারী। যারা নিজ নিজ পরিবারে সন্তানদের পরিচর্যাসহ সাংসারিক বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন। ঘুম থেকে জেগে সংসার এর দায়-দায়িত্ব গুছিয়ে তারা বিদ্যালয়ে আসেন। অভিজ্ঞতা বলছে, এতে করে তারা নিজের নাস্তাটুকুও ঠিকমতো করে আসতে পারেন না। বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে, হাজিরা দিয়ে, সমাবেশে অংশগ্রহণ করে ছুটতে হয় শ্রেণিকক্ষে। অতঃপর শুরু হয় বিরতিহীন একটার পর একটা ক্লাস। অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী সংবলিত ক্লাস হলেতো কথাই নেই। প্রতিটা মূহূর্তে প্রয়োজন এনার্জি। এনার্জি না থাকলে তার কাছে আমরা কতটুকু আশা করতে পারি। সবশেষে তার বিরূপ প্রভাব এসে পড়ে শিক্ষার্থীদের উপর। যেমন, অল্পতেই রেগে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশিত পর্যায়ের সাপোর্ট না দেয়া, শিক্ষার্থীদের কাজ দিয়ে তদারকি না করে চেয়ারে বসে ঝিমানো ইত্যাদি।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বিদ্যালয় এর কর্মসূচির সাথে বিদ্যালয়ের একাডেমিক সুপারভিশন কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাগণের অফিস সময়কালের মধ্যেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা। অর্থাৎ বিদ্যালয় শুরুর ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর অফিস এর কার্যক্রম শুরু হয়। ফলে শিক্ষকগণ যথাসময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে কার্যক্রম শুরু করছেন কিনা তা তদারকি করা অনেক সময় হয়ে উঠে না। এতে করে অনেক শিক্ষক মধ্যবর্তী সময়ের এই সুযোগটুকু নিয়ে যথাসময়ে বিদ্যালয় কার্যক্রমও পরিচালনা করছেন না। ফলশ্রুতিতে সিস্টেম লস হচ্ছে।

তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে, সুশিক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদি সংযোজন করাসহ ঢাকা মহানগরীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের সময়সূচির একটা পরিবর্তন আনার জন্য, আমাদের একটু সচেতনভাবে ভেবে দেখা এখন সময়ের প্রয়োজন।

[লেখক : সহকারী ইনস্ট্রাক্টর, থানা রিসোর্স সেন্টার, ধানমন্ডি, ঢাকা]

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053310394287109