শিশুর পিঠে বইয়ের বোঝা কমেনি - Dainikshiksha

শিশুর পিঠে বইয়ের বোঝা কমেনি

আলম শাইন |

‘বইয়ের বাড়তি চাপে শিশুরা’- সপ্তাহদুয়েক আগে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল এটি। শিরোনামেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। চোখের সামনে ভাসতে থাকে শিশুদের অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগটি। এ ধরনের সংবাদ আমাদের প্রায়ই পড়তে হচ্ছে।

তাতে পাঠক যেমনি বিচলিত হচ্ছেন সেই খবর পাঠে, তেমনি বিষয়টি আমলে নিয়ে হাইকোর্ট একটি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন বছরদুয়েক আগে। সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে (০৮.১২.২০১৬) দেশের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল- ‘শিশুদের পিঠে শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ ওজনের বেশি ব্যাগ বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাইকোর্ট।’

শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত যেন না হয়, সেজন্য সরকারকে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। নির্দেশনা দেয় রায়ের কপি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই এটি কার্যকর করতে, যা ছিল হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই রায় আজ অবধি বাস্তবায়ন হয়নি। আদৌ সেটি বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান আমরা।

দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনা করলেও স্কুলগুলোর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। জানা নেই কিন্ডারগার্টেনের সঠিক সংখ্যাও। নেই অনেক কিন্ডারগার্টেনের নিবন্ধনও। এছাড়াও এখানে কী ধরনের বই পড়ানো হচ্ছে, তার তদারকিও নেই, যা সরকারের জানা থাকা অতি আবশ্যক। এখানে আরেকটি বিষয় আলোকপাত করতে হচ্ছে- অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেনে ছুটিছাঁটার ক্ষেত্রেও অনিয়ম লক্ষ করা যাচ্ছে।

নিজেদের ইচ্ছেমতো ছুটির তালিকা তৈরি করছে তারা। বিশেষ করে ইসলামী কিন্ডারগার্টেন নামদারি কিছু প্রতিষ্ঠান ২১ ফেব্রুয়ারিসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসেও ক্লাস নিচ্ছে। এটি বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে মফস্বল এলাকায়; যেখানে সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম।

সংবাদপত্রের বিস্তারিত প্রতিবেদনে জানা যায়- সহায়ক বইয়ের চাপে শিশুর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার কথাও। যে বইগুলো কি না আবার ওদের প্রত্যহ স্কুলব্যাগে ঢুকিয়ে বহন করতে হচ্ছে। একই ব্যাগে আবার বহন করতে হচ্ছে টিফিন বক্সসহ পানির বোতলও; যাতে অতিরিক্ত ওজনে শিশুর ঘাড় এবং পিঠে প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। ফলে ওদের মেরুদণ্ড বাঁকা হওয়ার পাশাপাশি কুঁজো হয়ে যাচ্ছে শরীরটাও। এছাড়াও শ্বাসকষ্টে ভুগতে হচ্ছে অনেক শিশুকে, যা শিশুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।

চিকিৎসকদের মতে, ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় শিশুর হাড় ও মাংসপেশি যথেষ্ট নরম থাকে। সামান্য আঘাতে অথবা চাপে মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এ বয়সেই। অথচ এই বয়সেই শিশুকে ব্যাগের বোঝা বইতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত; যে বোঝাটি পিঠে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হচ্ছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের শিশু শিক্ষার্থীদের। এটা ওদের জন্য পীড়াদায়কও বটে।

শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর শুধু বইয়ের চাপই দিচ্ছে না কিন্ডারগার্টেনগুলো, করছে ব্যাপক অনিয়মও। তন্মধ্যে দৃষ্টিকটু অনিয়মটি হচ্ছে- কিন্ডারগার্টেনের প্রধানের পদ-পদবি; যে পদবিটি ব্যবহার করা হচ্ছে অধ্যক্ষ হিসেবে। হাস্যকর হলেও সত্যি, সেই অধ্যক্ষদের বেতনাদি হাজার দুই-আড়াইয়ের মধ্যে। শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক বড়জোর। আর সহকারী শিক্ষকদের বেতন হাজার-দেড় হাজারের মধ্যে (কিছু কিছু কিন্ডারগার্টেনে বেশি হতে পারে)।

শিক্ষকরা অবশ্য এ বেতনাদি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। তার প্রধান কারণ তিনি শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন এলাকায়; যাতে তার টিউশন করার সুযোগ বেড়ে যায় মুহূর্তেই। আর কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষেরও পোয়াবারো; রদ্দিমাল চালিয়ে কম বেতনাদি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন! এ হচ্ছে দেশের কিন্ডারাগার্টেনের হালহকিকতের যৎসামান্য চিত্র।

লাভবান প্রতিষ্ঠান বিধায় দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলো সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে আজকাল; ফলে শহরের পাশাপাশি মফস্বল শহরেও কিন্ডারগার্টেন গড়ার হিড়িক পড়ছে। অলিগলি ভরে গেছে কিন্ডারগার্টেনের সাইনবোর্ডে। কোনোমতে একটা দালান ভাড়া নিতে পারলেই কিন্ডারগার্টেন দাঁড়িয়ে গেল!

তারপর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ক্লাস নেয়া শুরু হয়। নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা থাকলে হয়তো এ সুযোগটি পেত না তারা। কাঠখড় পুড়িয়ে কিংবা শর্ত পূরণ করে প্রতিষ্ঠানটি গড়লে অনিয়মের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করত।

সে ধরনের বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেকের ধারণা- কোনোমতে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করাতে পারলেই কেল্লাফতে। পরবর্তীকালে বছরের পর বছর সুফল বয়ে আনবে যদি শিক্ষার্থীদের ভালো রেজাল্ট করানো যায়; সেটি করছেনও তারা, যা ধরে রাখতে শিক্ষকরা মরিয়া হয়ে শিশুদের নিয়মিত ঘষামাজা করছেন। বইয়ের বোঝা, পাঠের চাপ চাপিয়ে শিক্ষার্থীকে বিকলাঙ্গ বানিয়ে ফেলছেন। অর্থাৎ ভালো রেজাল্ট করতেই হবে; যেন এই অঙ্গীকারে কিন্ডারগার্টেনের পথচলা।

তথাপিও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমরা নিরুৎসাহিত করছি না। বরং নিরুৎসাহিত করছি কিন্ডারগার্টেনের ব্যবস্থাপনাকে। স্পষ্ট সরকারি নীতিমালা না থাকার কারণে কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব মনগড়ায় তৈরি নীতিমালা দ্বারা স্কুল পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছেন। শিশুকে চৌকস করে গড়ে তোলার নিমিত্তে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।

এতে শুধু শিশুর পিঠে বইয়ের বোঝাই সওয়ার হচ্ছে না, সওয়ার হচ্ছে অভিভাবকের কাঁধে খরচের বাড়তি চাপও। বলা যায়, নানা ধরনের সহায়ক বইয়ের চাপে শিশু যেমন নাজেহাল হচ্ছে, তেমনি অতিরিক্ত ফি আদায়ের ফলে অভিভাবকরাও নাজেহাল হচ্ছেন। সহায়ক বইয়ের ক্ষেত্রেও একধরনের বাণিজ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকাশনীর লোকেরা

কিন্ডারগার্টেনের প্রতিষ্ঠাতার কিংবা অধ্যক্ষের সঙ্গে আঁতাত করে সহায়ক বই পাঠ্য করিয়ে বাণিজ্যের পসার ঘটায়। এতে লাভবান উভয়ে হলেও শিক্ষার্থী-অভিভাবক বেকায়দায় পড়ে যান। দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলোর অনিয়মের আরেকটি চিত্র এটি। সেই অনিয়মের ভুক্তভোগী হয়েও অভিভাবকরা প্রতিবাদী হচ্ছেন না। কারণ অভিভাবকদের বিশ্বাস- কিন্ডারগার্টেনে না পড়লে কিংবা বেশি বই না পড়লে বুঝি শিক্ষার্থীদের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না; বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না ওরা।

অথচ এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এত খরচা করে এবং শিশুকে দিয়ে বাড়তি বোঝা টানিয়েও খুব ভালো ফল পাচ্ছেন না অভিভাবক। শিশু সাময়িক ভালো রেজাল্ট করলেও পিছিয়ে পড়ছে শারীরিক ও মানসিক চাপে বিধ্বস্ত হয়ে। পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাস্তবতা থেকে ছিটকেও পড়ছে অনেকেই। ছিটকে পড়ছে সৃজনশীলতা থেকেও। ফলে উপরের ক্লাসে কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে হাস্যরসের শিকার হচ্ছে।

সেই শিক্ষার্থীরা পরবর্তীকালে প্রাইভেট ভার্সিটি কিংবা মেডিকেল কলেজে স্থান পেলেও সৃজনশীল হতে পারছে না কোনোমতেই। অর্থাৎ মেধাবী হতে গিয়ে মেধা হারিয়ে হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনেও দুর্গতি পোহাতে দেখেছি আমরা। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়েও তারা কর্মক্ষেত্রে মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়নি।

ভুল চিকিৎসা অথবা আনাড়ি হাতের ডিজাইন করে বিপদ ঘটিয়ে কর্তৃপক্ষকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছেন; যার শত হাজার নজির রয়েছে দেশে। উল্লেখ্য, এখানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে প্রতিটি ক্ষেত্রে কিংবা প্রতিটি পদেই এমন নজির লক্ষণীয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে- আজ যারা দেশের কর্ণধার কিংবা উচ্চপর্যায়ে আসীন, তাদের অধিকাংশই সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ চুকিয়ে এসেছেন। আকাশচুম্বী সফলতাও অর্জন করেছেন তারা। তাদের কিন্তু কিন্ডারগার্টেনে পড়তে হয়নি। পড়তে হয়নি ইংলিশ মিডিয়ামেও। অথচ তারা কম মেধাবী, তা বলা যাবে না।

দেশের প্রতিটি ক্ষেত্র এখনও তাদের মেধার স্রোতে সিক্ত। সেই মেধাবী মানুষগুলোর কথা মনে এনে আমরা বলতে পারি- খুব কঠিন এবং খুব বেশি বইয়ের প্রয়োজন পড়ে না মেধাবী শিক্ষার্থী গড়তে। প্রয়োজন শুধু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সদিচ্ছা।

 

আলম শাইন : প্রাবন্ধিক

 

সৌজন্যে: যুগান্তর

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031189918518066