‘হঠাৎ একদিন দেখলাম একটি নতুন ছেলে মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এলেন। তখনই জানতে চাইলাম কে এ? একজন জানালেন, এর নাম খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। পরিচিত হই খালেদের সঙ্গে। কথায় কথায় একদিন খালেদ জানান, ধানমণ্ডিতে শেখ হাসিনার বাসভবনে তিনিই গুলি চালিয়েছিলেন। এ কথা শুনে আঁতকে উঠি। বিষয়টি জানাই সম্রাটকে, যেন খালেদ যুবলীগে ঢুকতে না পারেন। কিন্তু ফলাফল হয় উল্টো। একপর্যায়ে আমার অবস্থানই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। খালেদকে লুফে নেন সম্রাট। সম্রাটের বদান্যতায় খালেদ হয়ে যান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।’ শনিবার (১৯ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ওমর ফারুক।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গতকাল শুক্রবার আক্ষেপ করে র্যাবের হাতে গ্রেফতার, যুবলীগ থেকে বহিষ্কার ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিষয়ে প্রতিবেদককে এ কথাগুলো বলেন যুবলীগের এক নেতা। তিনি জানান, সম্রাট দলে সন্ত্রাসীদের জায়গা দিতে পছন্দ করতেন। এভাবে ধীরে ধীরে যুবলীগকে তিনি সন্ত্রাসীদের ক্লাবে পরিণত করেছিলেন। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সম্রাট তাঁর এই সন্ত্রাস থিউরিতে সফল হলেও বড় ক্ষতি হয়ে গেল দলের। দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ নেতারা চলে গেছেন আড়ালে। আর সন্ত্রাসীরা ভিড়তে থাকে যুবলীগে। শুধু এই যুবলীগ নেতাই নন। তাঁর মতো আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তাঁরাও একই ধরনের অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ নেতা খাজা মোহাম্মদ মোহসিন বলেন, ‘আমি ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদের জন্য প্রত্যাশী ছিলাম। সম্রাটের কাছে সিভিও জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে খালেদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করেন। আমি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগের রাজনীতি করে আসছি। অথচ ওই কমিটিতে আমাকে বঞ্চিত করা হলো।’
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনির ২০০১ থেকে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বৃহত্তর মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের পর বিএনপি সরকারের আমলে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। তাঁকে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কমিটিতে রাখা হয়নি। শেষে দুঃখ-ক্ষোভে ঢাকার রাজনীতি থেকে সরে চলে যান নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। বর্তমানে তিনি নবীনগর উপজেলা চেয়ারম্যান।
গতকাল মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘ওদের যুবলীগ (সম্রাটদের) ছিল আওয়ামী লীগকে ডোবানোর লীগ। যাঁরা শিক্ষিত, তাঁদের কমিটিতে রাখেনি। যাঁদের সন্ত্রাস করার রেকর্ড রয়েছে তাঁদের কমিটিতে নিয়েছেন সম্রাট।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে যুবলীগের যে কমিটি গঠন করা হয়, আমিও সিভি জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু কমিটিতে যাঁদের নাম দেখলাম, সেখানে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই নেতাদের মতো আরও অনেককে সম্রাটের কারণে যুবলীগের রাজনীতিতে বঞ্চিত হতে হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সম্রাট যোগ্যদের বঞ্চিত করে এসব কাজ করার সাহস পেতেন যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাকে ‘ম্যানেজ’ করে। তাঁরা সম্রাটের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে তাঁর কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতেন। আর সম্রাটের হাত ধরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগীরা অনুপ্রবেশ করে যুবলীগে।
নাম প্রকাশ না করে আরেক যুবলীগ নেতা বলেন, নিবেদিনপ্রাণ নেতাদের পছন্দ করতেন না সম্রাট। তাঁর পছন্দ ছিল সন্ত্রাসীদের। তাঁর চাওয়া ছিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগকে সন্ত্রাসীদের ক্লাবে পরিণত করা। যে কারণে সৎ জীবনযাপন করা অনেক যুবলীগ নেতা চলে গেছেন রাজনীতির আড়ালে। আর এই সুযোগে খালেদ, আরমানদের উত্থান হয় যুবলীগে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পরামর্শ অনুযায়ী সম্রাট যুবলীগের পদ-পদবি ভাগাভাগি করতেন বলে তথ্য মিলেছে।
অন্যদিকে গত মঙ্গলবার রমনা থানায় দায়ের করা অস্ত্র ও মাদক আইনের দুটি মামলায় সম্রাটকে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। মামলা র্যাবে হস্তান্তর করায় গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সম্রাট ও তাঁর সহযোগী আরমানকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে র্যাব-১ তাদের হেফাজতে নেয়। সম্রাট নিজেকে অসুস্থ দাবি করায় র্যাব সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। গতকাল জিজ্ঞাসাবাদের দ্বিতীয় দিনেও জিজ্ঞাসাবাদের আগে চিকিৎসক তাঁর চেকআপ করেছেন।
জানতে চাইলে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম গতকাল শুক্রবার বিকেলে বলেন, ‘তাঁকে (সম্রাট) জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি যেসব তথ্য দিচ্ছেন তা খতিয়ে দেখা হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট কোটি কোটি টাকার উৎস জানাচ্ছেন। কোন কোন নেতার কাছে সেই টাকার অংশ পাঠানো হতো, কাদের পরামর্শে যুবলীগ চালানো হতো, সব কিছুই জানাচ্ছেন তিনি। যাঁদের নাম বলছেন তাঁদের বিষয়েও খোঁজ-খবর নিচ্ছে র্যাব।
জানা গেছে, সম্রাট আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে কোটি কোটি টাকা দিতেন নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব ধরে রাখতে। এ ছাড়া পুলিশের অসাধু সদস্য থেকে শুরু করে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকেও টাকা দিতেন সম্রাট।