সমরনীতি থেকে আমার রাজনীতি | মতামত নিউজ

সমরনীতি থেকে আমার রাজনীতি

সেই স্কুলজীবন থেকে সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে নিজেকে স্বপ্ন দেখতাম। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আইএসএসবিতে নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিক ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করলে আমার সেই স্বপ্নপূরণ হয়। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কোয়েটার ৩৬ নং বেলুচ রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করি। ১৯৬৯ খ্রিষ্টা

সেই স্কুলজীবন থেকে সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে নিজেকে স্বপ্ন দেখতাম। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আইএসএসবিতে নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিক ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করলে আমার সেই স্বপ্নপূরণ হয়। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কোয়েটার ৩৬ নং বেলুচ রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করি। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন হিসেবে চট্টগ্রাম সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিই। একই বছর চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি হই। আমি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম কাতারের যোদ্ধা-সংগঠক।

দেশ ও জাতির মুক্তির লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারা দিয়ে পুরো নয় মাস জীবনবাজি রেখে লড়াই করি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লড়াই ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক ‘কুমিড়ার যুদ্ধ’ আমার নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিলো। যা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। কুমিড়ার এই লড়াইটিই ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ও মুখোমুখি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ২৯ মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের মদনাঘাটস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমার নামে একটি ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। ঘোষণাটি ছিল ‘যার যার অস্ত্র নিয়ে লালদীঘি ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করুন’। সেই দিনের সেই ঘোষণা আর কুমিড়ার লড়াই আজ ইতিহাসের অংশ। পরে ৩ নং সেক্টরের তেলিয়াপাড়া, ধর্মগড়, মুকুন্দপুর, আশুগঞ্জের যুদ্ধেও অসীম সাহসিকতায় লড়াই করি।  মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে এবং পরে সিলেট অঞ্চলে শত্রু মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমার লড়াই চলে। কুমিড়া থেকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম তা শেষ করি ১৪ ডিসেম্বর আশুগঞ্জের লড়াই দিয়ে।

পাঠকদের আজ আমি কুমিড়ার লড়াই নিয়ে স্মৃতিচারণ করবো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য অধ্যায় ‘কুমিড়ার যুদ্ধ’। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু বন্দি হওয়ার আগে স্বাধীনতা ঘোষণার পর এটাই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সরাসরি যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্টখ্যাত এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ সন্ধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের ২৭ মার্চের আলোচিত ঘোষণা পাঠের একদিন আগে। ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেয়ার সুভাগ্য হয়েছিল আমার। সেদিন একটি হেভি মেশিনগান ও কয়েকটি লাইটগান এবং রাইফেল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্তিশালী ব্যাটালিয়ানের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা মাত্র ১০২ জন যোদ্ধা। যাদের মধ্যে সিভিলিয়ানও রয়েছেন। এই যুদ্ধে লে. কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ারসহ পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫২ জন সেনা নিহত হন। 

সমরনীতি থেকে আমার রাজনীতি

দিনটি ছিলো ২৬ মার্চ ১৯৭১। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো সন্ধ্যার আগেই ক্যান্টনমেন্ট দখল করবো। কিন্তু জানতে পারলাম শত্রুপক্ষের শক্তি বৃদ্ধির জন্য কুমিল্লা থেকে ২৪ নং এফএফ রেজিমেন্ট এগিয়ে আসছে। এটা কীভাবে প্রতিরোধ করবো, সেই ভাবনাই আমাকে পেয়ে বসলো। সকাল থেকে অস্ত্র ও সৈন্য জোগার করতে করতেই বিকাল ৫টা বেজে যায়। এরপরই ২৪ নং এফএফকে প্রতিহত করার জন্য কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হলাম। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআর-এর মাত্র ১০২ জন সৈন্য নিয়ে অভিযানে বের হলাম। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সম্বল মাত্র একটা হেভি মেশিনগান, বাকি সব রাইফেল। এতো অল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে পুরো একটা সুসংগঠিত ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাওয়ার ঝুঁকি যে কী ভয়াবহ এবং তার পরিণাম যে কী মারাত্মক হতে পারে সেদিন তা উপলব্ধি করতে পারিনি। 

আমি আমার দলের সবাইকে ৪টি ট্রাকে উঠালাম আর অন্য একটি ট্রাকে গুলির বাক্স উঠিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটা মোটরসাইকেলে চড়ে সবার আগে চললাম। উদ্দেশ্য এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে পথের দু’পাশে এমন একটি সুবিধাজনক স্থান খুঁজে নেয়া, যেখান থেকে শত্রুর ওপর সঙ্গে সঙ্গে আঘাত হানা যায়। শুভপুরের উদ্দেশে সেদিন আমাদের যাত্রাপথের দৃশ্য ভোলার নয়। রাস্তার দুপাশে শত শত মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যে কলকারখানার শ্রমিকই বেশি। মুখে তাদের নানান স্লোগান, সেই হাজারও কণ্ঠে আকাশ-বাতাস মুখরিত হচ্ছিলো।

গত রাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া বর্বরবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ, নির্মম হত্যা, বিশেষ করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদেরকে পাশবিকভাবে হত্যা করার খবর এরই মধ্যে প্রত্যেক মানুষের কানে পৌঁছে গেছে। যে কোনোভাবে এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য যেনো তারা প্রস্তুত। সুতরাং যখনই তারা দেখতে পেলো খাকি পোশাক পরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর জওয়ানরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। মুহুর্মুহু তারা স্লোগান দিতে লাগলেণ ‘জয় বাংলা’ বলে। 

আমাদের সৈন্যবোঝাই ট্রাকগুলো তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। তখন সন্ধ্যা ৬টা। আমরা কুমিড়ায় পৌঁছে গেলাম। শত্রুকে বাধা দেয়ার জন্য স্থানটি খুবই উপযুক্ত মনে হলো। পথের ডানে পাহাড় এবং বামদিকে আধা মাইল দূরে সমুদ্র। শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধক, সেজন্য শত্রুকে এগোতে হলে পাকা রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। তাই সেখানেই পজিশন নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যেখানে পজিশন নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই, এর পেছনে একটি খাল। ওই খাল থেকে ৪০০/৫০০ গজ সামনে অর্থাৎ উত্তর দিকের জায়গা বেছে নিই।

খালটা কোনো পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন কোনো বাধা নয়। উদ্দেশ্য ছিলো যদি শত্রু আমাদের বর্তমান পজিশন ছাড়তে বাধ্য করে, তখন খালের পেছনে গিয়ে পজিশন নিতে পারবো। এটা ছিলো আমার বিকল্প পরিকল্পনা। এলাকাটা দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রতিরোধের (অ্যামবুশ) পরিকল্পনা তৈরি করে নিলাম। স্থির করলাম ১ নং প্লাটুন ডানে, ২ নং প্লাটুন বামে এবং ৩ নং প্লাটুন আমার সঙ্গেই থাকবে। তিনজন প্লাটুন কমান্ডারকে ডেকে খুব সংক্ষেপে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম এবং নিজ নিজ স্থানে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পজিশন নিতে নির্দেশ দিলাম। আমার নির্দেশ অনুযায়ী হেভি মেশিনগানটি পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ফিট করা হলো। ইপিআর সুবেদার নিজে ভারী মেশিনগানটির সঙ্গে রইলেন। 

কুমিড়া পৌঁছেই মোটরসাইকেলে একটা যুবককে আমরা পাঠিয়ে ছিলাম শত্রুর অগ্রগতি সম্পর্কে খবর নিতে। এরই মধ্যে তিনি খবর নিয়ে এসেছেন যে শত্রু আমাদের অবস্থানের আর বেশি দূরে নেই। মাত্র চার-পাঁচ মাইল দূরে। তবে তারা ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে আসছেন। যে লোকটাকে পাঠিয়েছিলাম, তিনি পাকিস্তানি সেনাদের কাছাকাছি গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে ফিরে এসেছেন। তিনি জানালেন, পাকিস্তানি সেনাদের পরনে কালো বেল্ট, কাঁধে কালো ব্যাজ এবং কী যেণো একটা কাঁধের ওপর, তা-ও কালো। তখন আমি নিশ্চিত হলাম যে, ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈন্যরাই এগিয়ে আসছেন। কারণ, ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সদস্যরাই কেবল কালো বেল্ট, কালো ব্যাজ ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের অবস্থানের ৭০/৮০ গজ দূরে একটা বড়ো গাছ ছিলো। স্থানীয় লোকদের সাহায্য নিয়ে গাছের মোটা ডালটা কেটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেললাম। গাছের ডাল দিয়ে রাস্তার ওপর একটা ব্যারিকেড সৃষ্টি করলাম। রাস্তার আশপাশ থেকে কিছু ইট এনে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রাখলাম। এতো অল্প সময়ে জনসাধারণ কীভাবে গাছের মোটা ডালটা কেটে ও ইট সংগ্রহ করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করল, আজ তা ভাবতে অবাক লাগে। 

প্রায় এক ঘণ্টা শত্রুর প্রতীক্ষায় কেটে গেলো। সন্ধ্যা তখন প্রায় ৭টা। আমরা শত্রুর অপেক্ষায় ওত পেতে আছি। আমাদের সামনে শত্রু বাহিনীর উপস্থিতি প্রায় আসন্ন বলে মনে হলো। দেখলাম তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। ব্যারিকেড দেখে সামনের গাড়িগুলো থেমে গেলো। কয়েকজন সিপাহি গাড়ি থেকে নেমে ব্যারিকেডের কাছে এলেন। ওদের কেউ কেউ ইটগুলো তুলে দূরে ফেলে দিতে লাগলেন। পেছনের গাড়িগুলোর তখন সামনে এগিয়ে এসে জমা হতে লাগল। শত্রুরা যখন ব্যারিকেড সরাতে ব্যস্ত, তখনই আমি প্রথম গুলি ছুড়লাম।

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডানদিকের ভারী মেশিনগানটি গর্জে উঠলো। শুরু হলো শত্রুনিধন। চারদিক থেকে কেবল গুলি আর গুলি। ভারী মেশিনগান থেকে মাঝে মাঝে উজ্জ্বল ট্রেসার রাউন্ড বের হচ্ছে। আমাদের আকস্মিক আক্রমণে শত্রুপক্ষ হতচকিত। ওদের সামনের কাতারের অনেকেই আমাদের গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন। সে কী ভয়াবহ দৃশ্য! তাদের কাতর আর্তনাদ আমাদের কানে আসছিলো। আর যারা দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলোন0, তারাও মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুদের পেছনের সৈন্যরা এ অবস্থা সামলে নিয়ে মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারি থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করলেন। এভাবে কতক্ষণ চলল। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে শত্রুর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা প্রাণপণ লড়ে তারা শেষপর্যন্ত দুই ট্রাক অস্ত্র ফেলে পিছু হটতে বাধ্য হন। পড়ে রইলো তাদের অনেকগুলো নিথর দেহ।

এই ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ৫৩ বছর আগের। এখন স্থানীয়ভাবে দিনটিকে স্মরণ করা হয়। স্বাধীনতার পর আর দশজনের মতো আমিও কঠিন শ্রম ও মেধা দিয়ে সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। দীর্ঘ ৩২ বছর সেনাবাহিনীতে সততা, আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে চাকরিকালীন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ আমার হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি হলো। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় তিনি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বিগ্রেড কমান্ডার হিসেবে বন্যা প্লাবিত প্রায় ৩০ হাজার বন্যার্ত লোককে সেনানিবাসে আশ্রয়-সেবা দিয়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করা। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ এপ্রিল দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগে সরকারের চীফ কো-অর্ডিনেটর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। ১৯৯৮-এর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগে দাউদকান্দির প্রত্যন্ত-দুগর্তদের পাশে সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি। ২০০৪-এর বন্যায়ও একই কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। ২০ মে, ১৯৯৬। এদিন বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছিলো এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সেদিন দেশ ও গণতন্ত্রের ওপর নেমে এসেছিলো প্রচণ্ড এক হুমকি। ঢাকার রাজপথে নামানো হয়েছিলো ট্যাংক। সে সময় একটি নিশ্চিত রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান থেকে দেশ, জাতি, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ হয় আমার।

চাকরি জীবনে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন আহমদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার (১৯৯১-৯৬) সরকারের সময় প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয় আমার। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে কয়েকদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও পিএসও ছিলাম। সব মিলিয়ে আমার মোট ৫ বছর ৮ মাস কেটেছে সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের পিএসও হিসেবে। চাকরিকালীন দাউদকান্দি উপজেলা থেকে ৪ কিমি দূরে সুবিধাবঞ্চিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য ১৯২ বিঘা জমির ওপর বিশাল এক কমপ্লেক্স গড়ে তুলি। যার সিংহভাগজুড়ে রয়েছে সমাজসেবা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি, ডাকঘর, ব্যাংক, হাসপাতাল, বাজার, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, স্টেডিয়াম, কবরস্থানসহ অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা রয়েছে। শুধু তাই নয়, দাউদকান্দি, মতলব, হোমনা, চান্দিনা, কচুয়া ও গজারিয়ার ৬/৭ হাজার বেকার যুবককে সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশে চাকরির ব্যাপারে সহায়তা করি।

আমার প্রত্যক্ষ রাজনীতির পদচারণা ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ এপ্রিল আওয়ামী লীগে যোগদানের পর থেকেই দলকে আরো সক্রিয় করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। সে সময় চারদলীয় জোট সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন, হামলা-মামলা উপেক্ষা করে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করি। শুধু এলাকায় নয়, ঢাকার রাজপথেও ব্যাপক সোচ্চার ছিলাম আমি। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের গ্রেনেড হামলায় আহত হই। ওয়ান ইলেভেনের সময় দল ও নেত্রীর পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিই। এজন্য আমাকে সেনা-সমর্থিত সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। 

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি ও মেঘনা) থেকে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ড. খন্দকার মোশারফ হোসেনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করি। সেই মেয়াদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে  নিজ দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হই। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে ড. খন্দকার মোশাররফকে আবারো পরাজিত করি। বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। 

জনপ্রতিনিধি হিসাবে দীর্ঘ ১৫ বছরে দাউদকান্দি ও মেঘনা উপজেলাকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছি। দুই উপজেলায় সরকারি অনুদানে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। সবচেয়ে অবহেলিত দ্বীপ উপজেলা মেঘনা। আমূল পরিবর্তন এসেছে চারিদিকে নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই উপজেলায়। সুবিধাবঞ্চিত এই উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোই শোচনীয় ছিলো যে, প্রায় দুই লাখ মানুষ এতোদিন বন্দি অবস্থায় জীবন যাপন করতে হতো। এই বন্দিত্বের অবসান ঘোচাতে এডিবির ১৩০ কোটি টাকার অর্থায়নে ভাটের চর-ওমরাকান্দা ১২ কিলোমিটার সড়কটি নিমাণ করা হয়। এখন রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি বাস যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়েছে। এই উপজেলার অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়নই ছিলো না। এখন সব ধরনের নাগরিক সেবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। একই অবস্থা দাউদকান্দিতেও। 

আমার স্ত্রী বেগম মাহমুদা আখতার ভূঁইয়া। তিনি দাউদকান্দির বিটেশ্বরের ঐতিহ্যবাহী ভূঁইয়া পরিবারের বিদ্যুৎসাহি, সাংস্কৃতিসেবী ও সমাজসেবক, বিশিষ্ট প্রকাশক, আহমাদ পাবলিশিং হাউসের স্বত্বাধিকারী স্বর্ণপ্রদকপ্রাপ্ত মরহুম মহিউদ্দিন আহমদের কন্যা। আমাদের তিন ছেলের সবাই মির্জাপুরে ক্যাডেট কলেজে কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়া শেষ করে। দ্বিতীয় ছেলে শওকত আলী মেধা তালিকায় এসএসসিতে ৭ম এবং এইচএসসিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। বর্তমানে সে ইংল্যান্ডে কর্মরত। ছোট ছেলে জুলফিকার আলীও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। বড় ছেলে মোহাম্মদ আলী সেনাবাহিনীতে মেজর পদে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি দাউদকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগ নেতা।

আমার আজকের লেখার শিরোনাম দিয়েছি ‘সমর নীতি থেকে আমার রাজনীতি’। অনেকে রাজনীতিকে পেশা মনে করেন। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে রাজনীতি মোটেই পেশা নয়। বৃহৎ পরিসরে রাজনীতি হলো, ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, দেশ, তথা বিশ্বের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। ৩২ বছর চাকরি জীবন শেষে জনগণের জন্যই আমার জীবন উৎসর্গিত। যেই মানবসেবার শুরুটা আমার কর্মজীবনের শুরুর দিন থেকে, মানুষের কল্যাণে সেই জীবন এগিয়ে চলছে রাজ নীতির পরিচয় বহন করার পরও। অর্থ্যাৎ সমর নীতি থেকে রাজনীতি হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে, মানুষের জন্য কল্যাণ, মানুষের জন্য সেবা। আমি দুটি পর্বেই ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, দেশ, তথা বিশ্বের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার চেষ্টা করেছি। তাই বিশ্বাস থেকে বললে পারি, আমি একজন সফল সমরবিদ এবং একজন সফল রাজনীতিবিদও। যতোদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন মানুষের কল্যাণে তাদের পাশেই থাকতে চাই। 

লেখক: সভাপতি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

সমরনীতি থেকে আমার রাজনীতি