সম্ভাবনাময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাচারী উপাচার্য - দৈনিকশিক্ষা

সম্ভাবনাময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাচারী উপাচার্য

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দর্শন বোঝা যায় '৭৩-এর অধ্যাদেশ দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ভিন্নমতকে স্বীকার করা, বৈচিত্র্যকে ধারণ করার ঔদার্য বিদ্যমান থাকতে হবে- বিষয়টি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ভালোমতোই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। নইলে আইন করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য স্বায়ত্তশাসনের অধ্যাদেশ জারি করে যেতেন না। কিন্তু গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর জন্মধন্য এবং তার নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে সেই স্বাধীনতার সন্ধান পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যেন হয়ে উঠেছে উপাচার্য নিয়ন্ত্রিত এক কারাগার। ফেসবুকে কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাকে বহিস্কার ও অকথ্য গালিগালাজের নজির আর কোথায় আছে? আমরা কি অর্ঘ্য বিশ্বাসের কথা ভুলে গেছি? ২০১৭ সালের নভেম্বরে এই শিক্ষার্থী শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের ও পরিবারের অপমানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় মূলত তার শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর প্রশাসনের বৈশিষ্ট্যের

ওপর নির্ভর করে। আজকে দেশব্যাপী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়েছে, তা ভীষণ নেতিবাচক। অথচ নানা অনিশ্চয়তা পিছে ফেলে এই বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রার শুরু থেকে অনেক ধনাত্মক সম্ভাবনাকে ধারণ করেই এগোচ্ছিল, যা এক পর্যায়ে এসে কিছু স্বার্থান্ধতার কবলে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে।

আমি মনে করি, কেবল একজন উপাচার্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সম্ভাবনাকে মাটিচাপা দিয়েছেন। অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন উপাচার্য হয়ে আসার পর সব শিক্ষককে নিয়ে যখন বসলেন, সবাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখতে চান গবেষকদের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। অধ্যাপকরা হবেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। কারণ সারাবিশ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে লোকে চেনে তার গবেষণা দিয়ে; গবেষক-অধ্যাপকদের পরিচিতি দিয়ে। সবাই খুবই আন্দোলিত। একবাক্যে তাকে আন্তরিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশ্বাস ভুল প্রমাণিত হতে বেশি দিন লাগেনি।

গবেষণার পথে শিক্ষকদের উৎসাহিত না করে, বরং বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে অনর্থক ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপ্রয়োজনীয় বিষয় আলোচনার সংস্কৃতি চালু করেন। তার আলোচনার বিষয় এবং উপস্থাপনভঙ্গি গোটা শিক্ষক সমাজ সম্পর্কে এই ক্যাম্পাসে ভয়ানক ঋণাত্মক ধারণা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ফলে একে একে মর্যাদা সচেতন সবাই তার আশপাশ থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরে যেতে লাগলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ব্যক্তিকে ঘিরেও গড়ে উঠল এক সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। লেখক আহমদ ছফার 'গাভী বিত্তান্ত' উপন্যাসের যেন বাস্তব চর্চা শুরু হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক দিন চাপা থাকার পর এখন জানছে সারা বাংলাদেশ।

একজন উপাচার্য নিজের পদকে কতটা নিচে নামাতে পারেন; বাসভবনে 'বিউটি পার্লার' তার উদাহরণ। আরও নানা অভিযোগ ক্যাম্পাসের বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। উপযুক্ত তদন্ত হলে সবই জাতির সামনে উন্মোচিত হবে। এমনকি উপাচার্যের ঘনিষ্ঠরাও কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল; কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তার প্রমাণ। ওই শিক্ষক এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, তার বিরুদ্ধে গোটা ক্যাম্পাস বিক্ষোভে নেমেছিল। এবার যেমন শিক্ষার্থী ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকেই দোষী করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে, তখনও অভিযুক্তের বদলে অভিযোগকারীদের বিপাকে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তার যথেচ্ছাচার আর ধামাচাপা দিতে পারেননি উপাচার্য ও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। যদিও 'প্রভুভক্তি'র উপহারস্বরূপ শাস্তির বদলে সেই নিপীড়ক শিক্ষককে সবেতন শিক্ষাছুটি দেওয়া হয়েছে।

এক ব্যক্তি যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠেন, তখন তার চরিত্রের অন্যান্য দিক স্খলিত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও তাই হয়েছে। দেখা গেছে, এখানে কোনো শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করতে চাইলে উপাচার্যের ক্ষমতাবলে তাদের নানাভাবে হয়রানি, অপমান-অপদস্থ করা হয়। অর্ঘ্য বিশ্বাস ছিল কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী। উপাচার্য ও তার আজ্ঞাবহ শিক্ষক সামান্য উপস্থিতির হারকে ছুতা করে অর্ঘ্যের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে অর্ঘ্য লিখে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতার ইতিহাস।

প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে উপাচার্য যখন-তখন যাকে-তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ আর বহিস্কারাদেশ জারি করে দেন। এটা যে শুধু শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই ঘটছে, এমন নয়; বহু শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে মতপ্রকাশ করায় নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষ শিক্ষকের পরিবারের লোকজনকেও। অন্যায় করার জন্য কেবল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাই এখানে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেনি; একই সঙ্গে এই উপাচার্য এত দানবীয় রূপে হাজির হতে পেরেছেন একটি সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের সিন্ডিকেটের সহায়তায়। তিনি ভর্তিবাণিজ্য ও নিয়োগবাণিজ্য এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, তা অকল্পনীয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে এখানকার কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিভাগের চেয়ারম্যান, হল প্রভোস্ট, প্রক্টরসহ কারোরই উপাচার্যের ইশারা ছাড়া স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে 'চেইন অব কমান্ড' বলে যে কাঠামো থাকতে হয়, তার বালাই এখানে নেই। প্রশাসনিক চর্চায় এই কাঠামোগত বিপর্যয় এখানকার সব শুভ উদ্যোগকে ব্যাহত করছে। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় মুখ্যত এখানে কোনো সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক ও একাডেমিক চর্চা চালু নেই। যে কারণে এখানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ও নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষক আত্মমর্যাদাবোধ রক্ষা করে চলতে পারেন না; জ্ঞানচর্চায় মনোযোগী হওয়া দূরে থাক।

সাম্প্রতিক আন্দোলনে উপাচার্য যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করে আন্দোলন দমন করতে চাচ্ছেন, যেভাবে বহিরাগতদের দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন, তা করে কি শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবেন? তিনি হয়তো উপাচার্য হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজীবন থাকবেন না। কিন্তু তিনি যে সম্ভাবনাময় এত তরুণ শিক্ষকের মনমানসিকতা, উদ্যম নষ্ট করে দিয়ে গেলেন, তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। শিক্ষকদের অনেকের একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়তে তিনি বাধা দিয়ে শিক্ষার পরিবেশকে ব্যাহত করেছেন। কাউকে কাউকে সীমাহীন যন্ত্রণা দিয়ে বাধা দিয়েছেন। এত শিক্ষার্থীর মন ও মননের চর্চা তিনি যে অথর্ব করে দিয়েছেন; এই বিপর্যয়েরই-বা সমাধান কী?

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যৌথ প্রয়াসে যাত্রা শুরুর কয়েক বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্জন কম নেই। অথচ এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সম্ভাবনা এভাবে থমকে যাবে?

 

জাকিয়া সুলতানা মুক্তা, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055208206176758