সরকারিকরণ : মুজিববর্ষের শ্রেষ্ঠ দাবি - দৈনিকশিক্ষা

সরকারিকরণ : মুজিববর্ষের শ্রেষ্ঠ দাবি

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বাঙালি জাতির ইতিহাসে মুজিববর্ষ চিরদিন এক স্মরণীয় বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের জন্য দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মনে ব্যাপক প্রাণ চাঞ্চল্যের সঞ্চার হয়েছে।  মুজিববর্ষের জন্য সবাই উন্মুখ তাকিয়ে আছে। ’৭১-র ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নির্মিত মঞ্চের দিকে লাখো জনতা যেমন অধীর আগ্রহে তাকিয়েছিল-এই বুঝি বঙবন্ধু আসছেন। উঁচু দালান ও গাছের মগ ডালে উঠে কী এক আবেগে জনতা অপলক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থেকেছিল প্রিয় নেতার দিকে। সেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা ছিল-শেখ মুজিবের হাত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন।

মুজিবের প্রতি বাঙালি হাজার বছর তাকিয়ে থেকেছে একটি লাল সবুজের পতাকা পাওয়ার জন্য। একটি ভূ-খণ্ডের জন্য হাজার বছর উন্মুখ হয়ে চেয়ে দেখেছে। সেই চাওয়া ব্যর্থ হয়নি। সেই প্রত্যাশা বিফলে যায়নি। শেখ মুজিব জাতির আশা আর প্রত্যাশার কথা জানতে পেরেছিলেন। দেশ ও জাতির প্রত্যাশা পূরণের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছেন। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। আত্মত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছেন। জীবনের চরম ঝুঁকিতে হুংকার দিয়ে বলেছেন- ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে বলবো, আমি বাঙালি। বাঙলা আমার দেশ। বাঙলা আমার  ভাষা। জয় বাংলা।’ মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি এমন দরদ আর ভালোবাসা অন্য কারো নেই বলে শেখ মুজিব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। দেশপ্রেমের বিচারে শেখ মুজিব আজ কেবল বঙবন্ধু নন, বিশ্ববন্ধুর মর্যাদায় অভিষিক্ত এক অন্য মানুষ।

কেবল ’৭১-র ৭ মার্চ রেসকোর্সে নয়, ’৭২-র ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে যেদিন স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে প্রথম ফিরে আসেন, এক নজর বঙবন্ধুকে দেখার জন্য জনতার হুড়মুড় এ দেশে আর কোনো নেতা কোনোদিন দেখেছেন কি না, কে জানে? হারানো ছেলেকে নিজের বুকে ফিরে পেয়ে সেদিন জাতির বুকে যে প্রত্যাশাটি জন্মেছিল, কে জানতো মাত্র ৩ বছরের মাথায় সেটির কবর রচিত হবে? জাতির সে প্রত্যাশা আজ অবধি কেবল ঘুরপাক খায়। কেবল আর্তনাদ করে। আজ তাই মুজিববর্ষের প্রাক্কালে জাতির প্রত্যাশার বহর বন্দরে নোঙর করেছে।

যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন কিছু মহামানবের জন্ম হয়েছে, যাদের হাত ধরে দেশ কিংবা জাতি ঘোর অমানিশার অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথ খুঁজে পেয়েছে। এরা আলোকবর্তিকা হয়ে আসেন। দেশ ও জাতির নমস্য হয়ে মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দেশ থেকে দাসত্ব প্রথার বিলোপ সাধন করে অমরত্ব লাভ করেছেন। তেমনি শেখ মুজিব ইতিহাসের পাতায় সোনালী অক্ষরে লেখা এক অবিস্মরণীয় নাম। যতদিন পৃথিবীর বুকে বাঙলা ভাষা ও বাঙালি জাতি টিকে থাকবে, ততদিন শেখ মুজিব প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে রইবেন। বাঙলার ইতিহাস কিংবা বাঙালির হৃদয় থেকে কেউ কোনোদিন শেখ মুজিব নামটি মুছে দিতে পারবে না। কথাটি বহুদিন আগে কবির ভাষায় এভাবে ফুটে উঠে-  ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরি, যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

একমাত্র দেশপ্রেমিক শাসক অনুধাবন করতে পারেন, কোন পথে দেশ ও জাতির উন্নতি সম্ভব? ফরাসি জাতির মহানায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট  উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া উন্নতির দ্বিতীয় পথ নেই। তাই তিনি নারী শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। ফরাসি জাতিকে উদ্দেশ্য করে আহ্বান করেছিলেন- ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ ফ্রান্স ও ফরাসি জাতির বিস্ময়কর অগ্রগতির পেছনে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সেদিনের ফ্রান্স আজ বিশ্বের অপরাজিত পঞ্চশক্তির অন্যতম।

আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবও উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া অন্য পথে জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। তাই স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করে সর্বপ্রথম তিনি শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। বিধ্বস্ত এক পোড়া মাটির দেশে দাঁড়িয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করেছিলেন। হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সরকারিকরণ করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি। পর্যায়ক্রমে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সরকারি করে দেন। আজকের মতো দেশের আর্থিক অবস্থা হলে সেদিন পুরো শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি করে দিয়ে যেতেন। যুগোপযুগী শিক্ষা চালু করে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি করার মানসে তিনি শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খোদাকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। সেই কমিশনের রিপোর্টটি বাস্তবায়িত হলে এতদিনে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা অবৈতনিক হয়ে যেতো। আজ আর শিক্ষা সরকারিকরণ নিয়ে ভাবতে হতো না। শিক্ষায় দৈন্য দশা থাকতো না। শিক্ষার মান নিয়ে ভাবতে হতো না। শিক্ষায় বাণিজ্যকীকরণ থাকতো না। নোট-গাইড ও কোচিং বাণিজ্যের বিস্তার ঘটতো না। সরকারি ও বেসরকারি বলে কিছু থাকতো না। আজ বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারতো আমাদের নতুন প্রজন্ম। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবচেয়ে পারফেক্ট হতো এই জনশক্তি। আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা, পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র ইত্যাদি নিয়ে কথা শুনতে হতো না। বিতর্কে জড়িয়ে যেতো না শিক্ষাব্যবস্থা।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরটি সরকারিকরণ হবে- এমন একটি কথা বহুদিন থেকে প্রচলিত ছিল। ’৭৫ পরবর্তী সময় থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পূর্ব পর্যন্ত এমন একটি আশার কথা দেশের মানুষজন বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এসেছেন। এরপর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ততবার সেই বিশ্বাসটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু কী তাই? জাতির জনকের কন্যা যেদিন এক ঘোষণায় ২৬ হাজার ৪০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেন, সেদিন থেকে সব বেসরকারি স্কুল-কলেজ তিনি একদিন সরকারি করে দেবেন বলে সবার মনে এক অসাধারণ আস্থা ও বিশ্বাস জন্ম নেয়। গত ২/৩ বছর আগে এক সাথে কয়েকশ বেসরকারি স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণ করে দেবার পর জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার হাতে সব স্কুল-কলেজ তথা গোটা শিক্ষাব্যবস্থা একদিন সরকারিকরণ হবে-এমন একটি স্বপ্নের মাঝে জাতি আজ একান্ত বিভোর হয়ে আছে।

আসছে ১৭ মার্চ জাতির জনকের শততম জন্মবার্ষিকী। তাঁর জন্ম শত বার্ষিকী ও মুজিববর্ষকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য সব বেসরকারি স্কুল-কলেজ এক সাথে সরকারিকরণ করা এখন সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি। এবার যদি দাবিটি পূরণ করা হয়, তাহলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা আরও বেড়ে যাবে। তেমনি তা মুজিববর্ষের জন্য সাফল্যের তিলক হয়ে এর সকল অর্জন ও সাফল্যকে অম্লান করে রাখবে। দেশ এখন তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ নয়। দেশের সামর্থ্য হয়েছে। এ কাজের জন্য সরকারকে কারো কাছে হাত পাততে হবে না। জাতির জনকের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে মুজিববর্ষকে অম্লান করে রাখার মানসে এবার সব বেসরকারি স্কুল-কলেজ সরকারি করা হবে, এই বিশ্বাস সকলের।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031712055206299