সরকারি পলিটেকনিক সংকটের অতলে - দৈনিকশিক্ষা

সরকারি পলিটেকনিক সংকটের অতলে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সাধারণ স্কুল-কলেজের চেয়ে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি বেশ ভিন্ন। এ মাধ্যমের পড়ালেখা অনেকটা ব্যাবহারিক। কারিগরিতে এমন ক্লাসরুমও আছে যেখানে ব্যবহারিকের সঙ্গে থিউরিটিক্যাল পড়ানো হয়। মূলত ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিকের ক্লাসরুম ৪০ জন শিক্ষার্থীর উপযোগী করে তৈরি করা। কিন্তু সেখানে বর্তমানে পাঠ নিচ্ছে ৬০ জন। এক শিফটের অবকাঠামো, শিক্ষক ও ল্যাবরেটরি দিয়ে চালানো হচ্ছে দুই শিফট। অন্যদিকে প্রতিটি সরকারি পলিটেকনিকে সেকশন বাড়ালেও বাড়েনি শিক্ষক। এ কারণে শিক্ষক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সরকারি পলিটেকনিকগুলো এভাবে নানা সংকটে জর্জরিত। বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের মাদার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচিত ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটিতে ১১টি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চারটি সেকশন, মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দুটি করে সেকশন আর ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার, এনভায়রনমেন্ট, আর্কিটেকচার, অটোমোবাইল, রিফ্রিজারেশন, ফুড এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একটি করে সেকশন রয়েছে।

কয়েক বছর আগে প্রতিটি সেকশনে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪০ জন থেকে বাড়িয়ে ৪৮ জন করা হয়। প্রতি ক্লাসে কয়েকজন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকায় কোনো মতে ক্লাস চলছিল। কিন্তু এরপর কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই প্রতি সেকশনে ৬০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা শুরু হয়। যদিও দুই বছর আগে সেটি কমিয়ে ৫০ জন করা হয়। এরপর ১১টি বিভাগে আরো ৯টি সেকশন বাড়ানো হয়। কিন্তু বাড়েনি শিক্ষক কিংবা ল্যাবরেটরি। ফলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে ঠিকভাবে বসার জায়গাও পায় না। এমন চিত্র উভয় শিফটে। আর এক শিফটের শিক্ষক দিয়ে চালাতে হচ্ছে দুই শিফট। এতে করে ক্লান্ত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠদানে ঠিকভাবে মনোযোগ দিতে পারেন না।

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রতিবছর ভর্তি করা হয় তিন হাজার শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীর জন্য ফিজিক্স ল্যাব একটি, কেমিস্ট্রি ল্যাব একটি। সব শিক্ষার্থীরই এ বিষয় দুটি রয়েছে। ফলে একজন শিক্ষার্থীর মাসে একবারের বেশি ল্যাব দুটি ব্যবহারের সুযোগ নেই। এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানে কনস্ট্রাকশন ল্যাব, হাইড্রোলিক ল্যাব, টেস্টিং ল্যাবও একটি করে। কিন্তু সিভিল, আর্কিটেকচার ও এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও একই ল্যাবের প্রয়োজন হয়। ফলে এক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ল্যাবে গেলে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা আর সুযোগ পায় না। আবার ডাবল শিফট হওয়ায় শিক্ষকদের পক্ষেও বেশি সময় দেয়া সম্ভব হয় না। কারণ এক শিফটের শিক্ষার্থীদের ল্যাব ক্লাস শেষ না হতেই অন্য শিফটের শিক্ষার্থীরা এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত সময়ের পরও ল্যাব ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। ডাবল শিফটের কারণে সে সুযোগ পান না শিক্ষার্থীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষক বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর বা বোর্ড থেকে যুক্তি দেয়া হয়, সরকারি তিতুমীর কলেজে একটি ক্লাসে সাড়ে ৩০০ শিক্ষার্থী একসঙ্গে ক্লাস করতে পারলে আপনারা ৬০ জনকে করাতে পারবেন না কেন? এর উত্তর আমরা কীভাবে দিব? সাধারণ আর কারিগরি শিক্ষা যে এক নয়, সেটা আগে কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে। সরকার ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ২০ শতাংশ ও ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কারিগরিতে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী আনতে চায়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না, সেদিকে নজর নেই।’

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ঢাকা পলিটেকনিকের শিক্ষক হাফিজ আহমেদ সিদ্দিক বলেন, ‘আমাদের শিক্ষক ও ল্যাবরেটরি সংকট রয়েছে। যেভাবে চলছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। তবে আশার বিষয়, সরকার এই খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। নানা উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়েছে। আশা করছি দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।’ 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকা পলিটেকনিকেরই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে অন্য পলিটেকনিকগুলোর কী অবস্থা সহজেই তা অনুমান করা যায়। দেশের অন্য পলিটেকনিকগুলোয় ল্যাব ও শিক্ষক সংকট আরও ভয়াবহ। সেগুলোতে শিক্ষার্থী থাকলেও সুযোগ-সুবিধা নিতান্তই নগণ্য।

দুই বছর আগে দেশের ৬৪টি সরকারি কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবং বগুড়া ভোকেশনাল টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়েছে। কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই এই ৬৫টি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে একযোগে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করতে গিয়ে যেখানে যে বিষয় নেই সেখানেও তা খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষক ও ল্যাবরেটরি সংকটে ঠিকভাবে ক্লাসই করাতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। সরকারি পলিটেকনিক এবং কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে এক বছরে ৫৭ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করানো গেলেও দক্ষতায় এগোনো যায়নি।

সূত্র মতে, সরকারি পলিটেকনিকে শিক্ষক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ সংকট কাটাতে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং অ্যানহ্যান্সমেন্ট প্রকল্পের (স্টেপ) আওতায় এক হাজার ৪৭ জন এবং স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ২৮৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাঁরা এখনো স্থায়ী হননি। ফলে  স্থায়ী শিক্ষকদের মতো তাঁরা প্রশিক্ষণও পান না। আবার প্রকল্পের চাকরি অস্থায়ী হওয়ায় অনেকে অন্য চাকরি খুঁজতে ব্যস্ত থাকেন। ফলে বাড়ছে না লেখাপড়ার মান। অন্যদিকে শূন্য রয়েছে পাঁচ শতাধিক শিক্ষকের পদ। টেকনিশিয়ানের অভাবও ব্যাপক। এমন সরকারি পলিটেকনিকও রয়েছে, বিদেশ থেকে ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি আনা হলেও দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাবে বছরের পর বছর তা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।

এ ছাড়া অস্থায়ী শিক্ষক ও স্থায়ী শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্ব। কারণ শূন্য পদগুলোতে অস্থায়ী শিক্ষকদের ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ তাঁরা ডিপ্লোমা পাস। জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে স্থায়ী শিক্ষকরা একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ২০ বছর ধরে চাকরি করছেন। অস্থায়ী শিক্ষক দ্বারা উচ্চ পদগুলো পূরণ হওয়ায় দীর্ঘদিন চাকরি করেও স্থায়ী শিক্ষকরা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। শিক্ষকদের এই দ্বন্দ্বের প্রভাবে ব্যাহত হচ্ছে পড়ালেখা।

এক শিফটের শিক্ষকরা দুই শিফটে দায়িত্ব পালন করায় এত দিন তাঁদের মূল বেতনের ৫০ শতাংশ অর্থ অতিরিক্ত হিসেবে প্রদান করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে শিক্ষক-কর্মচারীদের ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত প্রাপ্য হবেন বলে জানানো হয়। এতে তাঁরা ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের বেতনের ২৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত পাচ্ছেন। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীরা সন্তুষ্ট নন। তাঁরা প্রায়ই আন্দোলনে নামছেন, কর্মবিরতি পালন করছেন। আর এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা। গত ১ অক্টোবর থেকে সব সরকারি পলিটেকনিকে দ্বিতীয় পালার ক্লাস বর্জন করছেন শিক্ষকরা।

কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রওনক মাহমুদ বলেন, ‘সরকারি পলিটেকনিক এবং কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে বর্তমানে কিছু সমস্যা আছে। এর সমাধানে আমরা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ভারত সরকারের সহায়তায় ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। কারিগরি খাতের জনবল ২৫ হাজারে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে। এটা হলেই আর শিক্ষক সংকট থাকবে না। আর প্রকল্পের শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ী করতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করছি আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারব।’

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041139125823975