গত সপ্তাহে ঘটা করে অনুষ্ঠান করে নতুন শিক্ষকদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও শিক্ষাউপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। একই দিনে সরকারি হাইস্কুল শিক্ষকদের পদায়ন দিয়ে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু গত সপ্তাহে ২ হাজার ৬৫ জনকে পদায়ন দিতে গিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করেছে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে।
শহরের বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের অভিযোগ, যেসব স্কুলে শিক্ষক প্রয়োজন নেই, সেগুলোতে নতুন শিক্ষকদের পদায়ন করা হয়েছে। আর যেখানে শিক্ষক সংকট রয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক দেয়া হয়নি। শহর এবং ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে এমন এলাকার স্কুলগুলোতে পদের অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়ন করা হয়েছে। অথচ বদলি ও পদায়ন নীতিমালায় নতুন নিয়োগকৃতদের প্রথমে উপজেলার স্কুলে পদায়নের কথা বলা আছে। কিন্তু নতুন শিক্ষকদের রাজধানীর সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জেলা সদরের স্কুলে পদায়ন দেয়া হয়েছে। এর পেছনে স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগও করেছেন অনেকে।
কয়েকমাস আগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছ থেকে সারাদেশের হাইস্কুলগুলোতে শূন্যপদের তালিকা নিলেও পদায়নে সে তালিকার তোয়াক্কা করেননি আমলারা। মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছেমাফিক পদায়নে শিক্ষক সংকটে থাকা সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার মান ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অপর দিকে যেসব প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষকদের পদায়ন দেয়া হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর আগের শিক্ষকরা বদলি আতঙ্কে ভুগছেন। তারা বলছেন, অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়ন দেয়ায় বেতন ভাতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হবে। নতুন শিক্ষকদের নতুন করে পদায়ন দিয়ে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা শূন্যপদের তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও সে হিসেবে পদায়ন হয়নি। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষা অধিদপ্তরের দেয়া শূন্যপদের তালিকা অনুসারেই পদায়ন দেয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত নতুন শিক্ষক না থাকায় সব প্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক পাওয়া যায়নি। পদের অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়নের বিষয়ে তারা জানিয়েছেন, পদায়নের আদেশে পদ সমন্বয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এর সমাধান দেবে। কারো করো মতে, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শূন্যপদের তালিকা অনুসারে পদায়ন না করে বিষয়ভিত্তিক তালিকা অনুসরণ করে নতুন শিক্ষকদের পদায়ন দেয়ায় এমন জটিলতার সৃষ্টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শরীয়তপুরের পালংতুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে নতুন করে ১২ জন শিক্ষককে পদায়ন দেয়া হলেও আরও ১২টি শিক্ষক পদ শূন্য আছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. এমারত হোসেন মিয়া বলেন, নতুন ১২ জন শিক্ষক পেলেও আমার স্কুলে ইংরেজি, জীববিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ১২টি পদ শূন্য থাকবে। অথচ সামাজিক বিজ্ঞানে দুইজন শিক্ষক পেয়েছি। কিন্তু কেন এমন হলো বুঝতে পারছি না। আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে শূন্যপদের তথ্য দিয়েছি। সে অনুযায়ী পদায়ন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি।
এদিকে নরসিংদীর জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, নরসিংদী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ জন করে শিক্ষক পদায়ন দেয়া হয়েছে। অথচ এ প্রতিষ্ঠান দুইটিতে শূন্যপদ নেই। শূন্যপদ না থাকার পরেও রাজধানীর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার এই দুইটি প্রতিষ্ঠানে ২০ জন অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ কেন হলো, তা অনেকেই অনুমান করতে পারছেন। যদিও এতে এ সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকদের বেতন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শিক্ষা অফিস সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘ওই দুই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদ শূন্য নেই। তাদের কাছ থেকে শূন্যপদের তথ্যও আমরা পাইনি। কিন্তু প্রতিষ্ঠান দুটিতে ১০ জন করে মোট ২০ জন শিক্ষকের পদায়ন হয়েছে বলে জেনেছি।’
নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিউলি আক্তার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ না থাকার পরেও ১০ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। মনে হয় মন্ত্রণালয় তাদের পদায়নের সুবিধার জন্য এটি করেছে। শুধু আমার স্কুল নয়, অন্যান্য স্কুলেও এমনটা হয়েছে’। এর বেশি আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
এদিকে পদশূন্য না থাকার পরেও নরসিংদী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ জন অতিরিক্ত শিক্ষকের পদায়ন হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শূন্যপদ না থাকার পরেও তারা কেন এত শিক্ষক অতিরিক্ত দিলেন, বুঝতে পারছি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষামন্ত্রীর এলাকা চাঁদপুরের হাইমচর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজি, গণিত, ভৌতবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, চারুকলা বিষয়ে একজন শিক্ষকও নেই। স্কুলটিতে ওই সব বিষয়ে কোনো শিক্ষককে পদায়ন করেনি মন্ত্রণালয়। এ প্রতিষ্ঠানটিতে ১১টি পদের জন্য চাহিদা দেয়া হলেও ইংরেজি, গণিত, ভৌতবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষক পদায়ন করা হয়নি।
অথচ বদলি ও পদায়ন নীতিমালায় নতুন নিয়োগকৃতদের প্রথমে উপজেলার স্কুলে পদায়নের কথা বলা আছে। কিন্তু নতুন শিক্ষকদের রাজধানীর সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জেলা সদরের স্কুলে পদায়ন দেয়া হয়েছে।
জেলা সদরের দুই প্রতিষ্ঠানে একই বিষয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষককে পদায়ন, অপর দিকে উপজেলা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে ওই বিষয়ের শিক্ষককে পদায়ন না দেয়ার মধ্যে দুর্নীতির গন্ধও পাচ্ছেন কেউ কেউ। অভিযোগ উঠেছে, মন্ত্রণালয়ের সরকারি স্কুল শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা নতুন শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে নতুন শিক্ষকদের পছন্দ অনুযায়ী পদায়ন করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষকদের বদলি নীতিমালায় বলা হয়েছে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের থানা ও নতুন জেলা সদরে নিয়োগ দিতে হবে। তবে পদ শূন্য থাকলে পুরাতন জেলা ও বিভাগীয় সদরে নিয়োগ দেয়া যাবে। সাধারণভাবে থানা সদরের স্কুল থেকে প্রথমত জেলা সদর, এরপর পুরাতন জেলা সদর হতে বিভাগীয় পর্যায়ের স্কুলে শিক্ষক বদলির বিষয় বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু নতুন পদায়নের ক্ষেত্রে নিজেদের জারি করা বদলি নীতিমালা মানেননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের :
স্কুলগুলোতে পদায়নে কেন হ-য-ব-র-ল অবস্থা, জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমরা শূন্যপদের হালনাগাদ তথ্য নিয়ে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। মন্ত্রণালয় পদায়ন দিয়েছে। তারা কোন প্রেক্ষিতে পদায়ন দিলেন, তারাই জানান।
এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অপর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অধিদপ্তর যে তথ্য পাঠিয়েছে সে অনুযায়ী পদায়ন হয়নি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তা অনুসরণ করেননি।’
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ডা. সৈয়দ ইমামুল হোসেন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের। অধিদপ্তরের দেয়া শূন্য পদের তালিকা অনুযায়ী পদায়ন করা হয়েছে। শূন্য পদের বাইরে কাউকে পদায়ন করা হয়নি। যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে আগে থেকে যারা কর্মরত আছেন, তাদের সরিয়ে দেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকরা তাদের কর্তৃপক্ষ না জানিয়ে এসব কথা সাংবাদিকদের বলছেন কেন বুঝছি না’। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তারা কি জানেন না সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ দেয়ার আগে বা কথা বলার আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়?’
যে সমাধানের কথা বলছে মন্ত্রণালয় :
এ জটিলতার সমাধানের কথা জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ৩০ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে পদায়নের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা বিষয়ভিত্তিক শূন্যপদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদানপত্র তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করবেন। পদায়নকৃত পদে অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষক কর্মরত থাকলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধৃত শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক শূন্যপদের বিপরীতে সমন্বয়ের ব্যবস্থা করবেন।
এদিকে অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসেনও একই কথা বলেছেন। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানাতে হবে। জেলা শিক্ষা অফিস আমাদের কাছে এর লিখিত সমাধান চাইলে আমরা পদ সমন্বয়ের ব্যবস্থা করব।
পুরনো শিক্ষকরা বদলি আতঙ্কে :
এদিকে যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়ন করা হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর পুরনো শিক্ষকরা বদলি আতঙ্কে আছেন। তারা বলছেন, স্বজনপ্রীতি করে নতুন শিক্ষকদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে তাদের পদায়ন দেয়া হয়েছে। তবে সমন্বয় করা হলে তাদের সরে যেতে হবে। আর অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়ন দেয়ায় তাদের বেতনভাতা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘মনে করি মন্ত্রণালয় পুরনো শিক্ষকদের সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ জন্য এভাবে পদায়ন করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শূন্যপদের তথ্য পাঠিয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানভিত্তিক, কিন্তু মন্ত্রণালয় বিষয়ভিত্তিক তালিকা অনুসারে পদায়ন দেয়াতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
জানা গেছে, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংকট কাটাতে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (বিপিএসসি)। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর ২ হাজার ১৫৫ জনকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করে ফল প্রকাশ করা হয়। এরপর পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে গত ৩০ জানুয়ারি ২ হাজার ৬৫ জনকে পদায়ন করা হয়েছে।