সাংবিধানিক চেতনার বার্তাবাহক মিজানুর রহমান খান - দৈনিকশিক্ষা

সাংবিধানিক চেতনার বার্তাবাহক মিজানুর রহমান খান

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছেন। তিনি এখন স্থায়ী আকাশের বাসিন্দা। তিনি নিজের আত্মাকে গ্রহ নক্ষত্রের উপরে তুলে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি এখন ঐশ্বরিক সংবিধানের আওতাধীন নাগরিক।

কহলীল জিবরান বলেছিলেন এটা সত্য যে আমরা হলাম ধরাছোঁয়ার বাইরের উচ্চতা এবং আমরা হলাম সর্বোচ্চ উচ্চতা। কিন্তু ভালোবাসা হচ্ছে আমাদের প্রশ্নেরও উপরের উচ্চতা। বুধবার (১৩ জানুয়ারি) মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, মিজানুর রহমান খান আমাদের ভালোবাসার উপরের উচ্চতা। আমাদের প্রিয় মানুষ আজ সর্বাধিক দূরত্বে অবস্থান করছেন। কিন্তু বিশ্বাস করি সর্বাধিক দূরত্ব হলো সবচেয়ে কাছের। মিজানুর রহমান খান আমার হৃদয়ের ভেতরে লুকানো মানুষ।
এখন তিনি সংবিধান, গণতন্ত্র ও অধিকারের প্রশ্নে আর উদ্বিগ্ন হবেন না।

সংবিধান অধিকার নিয়ে জানাশোনার জন্য আর দুর্ভোগের শিকার হবেন না। রাজদণ্ডের রক্তচক্ষু দেখার দুর্ভাগ্য আর হবেনা। সংবিধান নামক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে আর প্রয়োজন পড়বে না। গণতন্ত্রের মন্দিরা বাজাবার প্রয়োজনও শেষ হয়ে গেছে। আদালত  বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে সংবিধানের ব্যাখ্যা চাওয়ার তাগিদ আর কোনোদিন অনুভব করবেন না। ক্ষমতার সিংহাসনে দন্ডায়মানদের কথা বিবেচনা করার আর ফুরসত পাবেন না।

তিনি আমাদের অন্যায় অনৈতিক সমাজ থেকে নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি কিছুদিনের জন্য আমাদের মাঝে দৃশ্যমান ছিলেন আর এখন চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেলেন। দেশ, জাতি  রাষ্ট্র নিয়ে তার উদ্বিগ্ন ও উত্তেজনাপূর্ণ কণ্ঠস্বর আর আমাদের কোনদিন  শ্রবণ করা সম্ভব হবে না।

সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও মেধা যে সমাজে অগ্রাহ্য হয়ে থাকে, অসততা যেখানে ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের পথকে উসকে দেয়, যেখানে অন্যায় অনৈতিক বেআইনি কাজ সন্তুষ্টি বিধান করে এবং অনেকের  মাঝে বিবেকবর্জিত প্রবণতা প্রকাশ পায় সেখানে মিজানুর রহমান খান বেশিদিন অবস্থান করার কথা নয়।

আমরা যেখানে সত্যের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চলেছি, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি যেখানে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে, যেখানে মিথ্যা অহরহ প্রবল বিক্রমে বিচরণ করে সেখানে একজন  ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিক টিকে থাকবে সেটা আশা করাই বাতুলতা। সমাজে যখন অন্যায়ের সাথে  আপস করার মনোবৃত্তি, ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতি, চারিদিকে অনিয়ন্ত্রিত বিপদ, যেখান সমাজ অপরাধীর পক্ষে দলিল-দস্তাবেজ উপস্থাপন করে, যেখানে নির্যাতন ও নিবর্তন আইনগতভাবে অনুমোদন পায় সেই সমাজে মিজানুর রহমান খান সত্য পথে অবিচল থাকতে পেরেছেন, তা আমাদের কালে এক বিরল ঘটনা।

প্রজাতন্ত্রে সংবিধানের নিশ্চয়তা বিধান করা ও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিচ্যুতি ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশ করাই ছিলো তার বৈশিষ্ট্য। আইনের শাসন নিরঙ্কুশ করতে, কাঠামোগত পৃথকীকরণ প্রশ্নে, সংবিধানের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চেতনা ও রীতি নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন গভীর অনুসন্ধানী।

মিজানুর রহমান খান ছিলেন আমাদের সাংবিধানিক চেতনার বার্তাবাহক। সংবিধানের নির্দেশনা এবং বাস্তবতার মাঝে বড় ধরনের তফাৎ অসংগতি সাংঘর্ষিক অবস্থান প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
গণতন্ত্রের আবরণে নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা হরণ, আমলাতন্ত্রের বাড়াবাড়ি, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির ফাঁকফোকর, সুশাসনের বড় মাপের ঘাটতি নিয়ে তার অভিমত ছিল দৃষ্টিগোচরযোগ্য ব্যতিক্রম।

মিজানুর রহমান খান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রে সাংবিধানিক আওতায় নির্বাচনী ব্যবস্থা কিভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ধ্বংস করে  জনগণকে বিচ্ছিন্ন ও  অবদমিত করে রেখে দেয়, কীভাবে ক্ষমতার অবৈধ বলয় সম্প্রসারণ করে। কীভাবে ক্ষমতার দাপটে চাতুর্যের সঙ্গে 'আদালত  ও আইন' মাড়িয়ে যাওয়া হয়।

তিনি বারবার সংবিধানের মৌলিক অধিকার (Fundamental rights), ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ(Separation of power) ও ক্ষমতার ভারসাম্য(Checks and balance) নিয়ে  প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। ক্ষমতার স্তুপীকৃতকরণ বা কেন্দ্রীভূতকরণ নিয়ে সংবিধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কোন কোন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা হ্রাস বা সীমিত করার দাবি উত্থাপন করেছেন। আমাদের গণতান্ত্রিক মুখোশ যখন ধ্বংসের মূর্তি নিয়ে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয় তখন তিনি সংবিধানের চেতনার মৃত্যুঞ্জয়ী আশার বার্তা জনমনে বিতরণ করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও গণতন্ত্রের অমর্যাদাকরণের প্রশ্নে রাষ্ট্রকে সতর্ক করেছেন।

তিনি বার বার বলতে চেয়েছেন গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক চেতনার বাস্তবায়ন ছাড়া সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হবে, স্থবিরতা প্রগাঢ় হবে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাবোধ গভীর হবে সর্বোপরি সমাজকে অস্থির ও অমানবিক করে তুলবে।

মিজানুর রহমান খান সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের বাসনা লালন করতেন, বিশ্ব রাজনীতি থেকে কর্তৃত্বপূর্ণ শাসনের অবসান কামনা করতেন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ব্যতীত বিচার বিভাগের প্রত্যাশা করতেন। নৈতিক ইস্যুতে ঐকমত্য সম্পন্ন গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন‌। যারা জনগণের অধিকারের বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করে কাজ করেছেন, বৈধ দায়িত্ব পালন করেননি  তাদের তিনি  ভর্ৎসনা করেছেন। তিন অবিরাম নিজের মতো করে বলার এবং চলার নৈতিক শক্তি সংরক্ষণ করেছেন।

তিনি আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অনেক নীতিকে অনৈতিক অবৈধ এবং অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছেন। এসব বয়ানের কারণে অনেক সময়  নিজের জন্য উচ্চমাত্রার ঝুঁকি বয়ে এনেছেন, রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দ্বারা অভিযুক্ত হয়েছেন বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। মানসিকভাবে মেরামত অযোগ্য ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তিনি কখনও নিজের ক্ষয়ক্ষতি বিপদ হ্রাসের লাগাম টেনে ধরতে চাননি। তিনি সাহসিকতা প্রয়োগ করে আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষা করে সত্য উচ্চারণ করে গেছেন। তিনি অসাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক সমাজের বিধ্বংস সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। নিবর্তনমূলক নীতি সমাজে অসন্তোষ ও বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়াবে সে বিষয়ে প্রতিনিয়ত আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।  জনগণের প্রতি দেয়া 'প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যয়' সরকার যখন ভুলে যায় তখন তিনি সমালোচনার বাণে সরকারকে ঘায়েল করেছেন। যারা রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন তাদেরকে নির্মমভাবে অভিযুক্ত করেছেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে  ক্ষমতা প্রয়োগের রসদ  যুগিয়েছেন। কুৎসিত ও বীভৎস অপকর্মের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার থেকেছেন। তিনি সমাজ প্রগতির  রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আস্থাবান ছিলেন।

নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক বলেছিলেন যা অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে কেননা তা প্রকারান্তরে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে।  অন্যত্র আমরা যেন ভুলে না যাই 'আজ আমরা যেভাবে বিবাদীর বিচার করছি ভবিষ্যৎ ইতিহাসও আমাদের সেই ভাবে বিচার করবে'। বিবাদীকে পার করতে গিয়ে যে বিষ আমরা প্রয়োগ করছি সে ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের মুখেও সে বিষের পাত্র নিয়ে নিচ্ছি।

মিজানুর রহমান খান এর উপর যারা যন্ত্রণার বাণ নিক্ষেপ করেছিলেন তারাও একদিন যন্ত্রণায় দগ্ধ হবেন, যারা অসম্মানজনক আচরণ করেছিলেন তারা লজ্জিত হবেন।

মিজানুর রহমান খানের মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে আসলো যা দ্রুত পূরণ হবার নয়। আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ, বিকৃত, অনৈতিক, অমানবিক বিজয় উল্লাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য মিজানুর রহমান খানের খুব প্রয়োজন ছিল।

 

লেখক: শহীদুল্লাহ ফরায়জী, গীতিকার

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042400360107422