ইংরেজিতে দক্ষ হ্যাকার তৈরির বিজ্ঞাপন দিয়ে শাস্তির মুখোমুখি শিবির পরিচালিত সাইফুরস কোচিং সেন্টার বন্ধের দাবি উঠেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে।
এদিকে নানা মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদ্বির করে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে।
তবে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আইনী ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারির পর সে অনুসারে কাজ শুরু করেছে মন্ত্রণালয়।
রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দ্রুতই এ বিষয়ে এ্যাকশন হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বইছে সমালোচনার ঝড়।
হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাট এবং একটি শব্দের বানান ভুলে ২ কোটি ডলার রক্ষা পাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশের পর দৈনিক প্রথম আলোয় বিজ্ঞাপন দেয় সাইফুরস। বিজ্ঞাপন দিয়ে সাইফুরস মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে উল্লেখ করে গত ২৩ মার্চ বুধবার সচিবালয়ে এক সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কোচিং সেন্টারটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সাইফুরসের পক্ষে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে অনেকেই তদ্বির করছেন। তারা এসে কর্মকর্তাদের বলছেন, আপাতত যেন সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয়। তদ্বিরের জন্য আসা ব্যক্তিরা সাংবাদিকদের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন যেন এ বিষয়ে রিপোর্ট লেখা না হয়।
সাইফুরসের সূত্রগুলো বলছে, শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণার পর গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রচারের পর সঙ্কটের মুখে পড়েছেন তারা। কর্মকর্তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে যে কোন ছাড় দিতে প্রস্তুত।
এদিকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করার কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি তুলেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এবারই প্রথম নয়, এর আগেও সাইফুরস বারবার নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী টেনে নিয়েছেন তারা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সেখানে তাদের কিছুই শেখানো হয়নি। বরং, এক কোর্স থেকে আরেক কোর্সে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এভাবেই বারবার শিক্ষার্থীদের থেকে কোর্স ফি-এর নামে টাকা আদায় করেছেন তারা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে, গত বছরের ১৬ অক্টোবর কোর্সের টাকা ফেরতের দাবিতে সাইফুরসের পান্থপথ, ফার্মগেট ও নীলক্ষেত শাখার সামনে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। সাইফুরসের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন সাইফুরসে কোর্স করা কেউ লজ্জায় তার সিভিতে উল্লেখ করেন না যে তিনি সেখানে কোচিং করেছেন।
রিসালাত ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, সাইফুরস আসলেই ভুয়া। সাইফুর স্যার আদৌ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক নন। আমিও গিয়েছিলাম ইংরেজি শিখতে। তারা বলেছিলেন, আমাকে এক মাসে বুলেট বানিয়ে দেবে ইংরেজিতে। বুলেট হওয়া দূরের কথা, খোসাটাও হতে পারিনি। যেই স্যারেরা ক্লাস নিয়েছিলেন, পরে জানতে পেরেছি, তারা আমাদের কলেজেরই নতুন স্যার, নতুন জয়েন করেছেন। অথচ বলা হয়েছিল, ঢাকা থেকে আসেন স্যাররা। এসি নেই, বসার পরিবেশ নেই। তবু ৫০০০ টাকা নিয়েছিল। অভিযোগ করেছিলাম হেড অফিসে, লাভ হয়নি। এ ধরণের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা উচিত।
তবে, হ্যাকার বানানোর বিজ্ঞাপনই প্রথম নয়, সাইফুরস এর আগেও নানা রকম বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপন দিয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হয়েছে কেবল সাইফুরস থেকে ইংরেজি শিখতে পারায় এমন একটি বিজ্ঞাপন সাইফুরস দিয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। এটা বিজ্ঞাপনের কেমন মাপকাঠি- জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন বলেন, এই বিজ্ঞাপন দুটি ছাঁচিকৃত অংশ প্রকাশ করেছে। একটি হলো, বিদেশ গমন সম্পর্কে আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ, অস্ট্রেলিয়ায় যেতে পারাকে সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিয়ে এটি সর্বজনের প্রত্যাশা বলে মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, অস্ট্রেলিয়া প্রববাসী পাত্রকে বিয়ে করতে পারাই একটি মেয়ের যোগ্যতা বলে প্রচার করা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, একজন মেয়ের জন্য ইংরেজির মতো একটি আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার প্রয়োজন হবে নিজে সাবলম্বী হওয়া, যোগাযোগ ক্ষমতা বাড়ানো কিংবা স্ব-উদ্যোগে ইংরেজিভাষী দেশে যাওয়ার জন্য নয়; শুধু বিয়ে করতে পারার জন্য। আর সেটাই তার সার্থকতা।
এভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী টানা কতটুকু নৈতিক- জানতে চাইলে গীতিআরা নাসরিন বলেন, বিজ্ঞাপনের মূল কাজতো পণ্য বা সেবার বিক্রি। এই বিজ্ঞাপণটিও তাই করেছে। তবে লক্ষণীয় যে, ইংরেজি শিক্ষাকে এখানে আধুনিক একটা ব্যাপার বলে মনে করা হয়, এবং বিশে যাওয়ার মতো একটি গণ্ডি অতিক্রমণের কথা বলছে যে বিজ্ঞাপন, মূল চিন্তাধারার দিক থেকে এই বিজ্ঞাপনটি সেই পুরনো গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। নারী যেখানে নানা ক্ষেত্রে কাজ করছেন, নানা জায়গায় ভ্রমণ করেছেন, শিক্ষার হার যেখানে বাড়ছে; সেখানে এ ধরনের বিজ্ঞাপণ নারীর যোগ্যতাকে শুধু বিবাহেই সীমাবদ্ধ করে রাখছে। শুধু এই বিজ্ঞাপণটিই নয়, আরও অনেক বিজ্ঞাপণ বিশ্লেষণ করলে আমরা নারীকে অনগ্রসর ছাঁচে ঢালা ভূমিকায় উপস্থাপন করার চেষ্টা দেখতে পাব।
এসব বিজ্ঞাপন নিয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আশরাফ উদ্দিন জুয়েল সাংবাদিকদের বলেন, বিজ্ঞাপনগুলো আমরা আমাদের জায়গা থেকে করেছি। আমাদের মূল জায়গাটা হলো ইংরেজি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা। কিন্তু ইংরেজি শেখানোর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য যা ইচ্ছে, তাই লিখে বিজ্ঞাপন কেন তৈরি করা হলো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইংরেজিটাকে হাইলাইট করা বা এর গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই আমরা এভাবে লিখেছি, কাউকে ছোট করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।