ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক ছিলেন মো. আবদুল কাদের। ৬ বছর ধরে ওই মাদরাসায় শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত তিনি। তবে একজন শিক্ষক হয়েও একই মাদরাসায় তার এক ছাত্রীকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যার নীলনকশায় জড়িত ছিলেন তিনি। কিন্তু কেন এমন ঘৃণ্য চক্রান্তে যুক্ত হন কাদের? ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তি ও পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে আবদুল কাদের জানান, শুরু থেকে নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা তিনি জানতেন। সিরাজকে রক্ষায় যে মুক্তি পরিষদ গঠন করা হয়েছিল তাও তাকে জানানো হয়। পিবিআই নুসরাত হত্যায় যে ১৬ জনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল কাদের। তারও মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে তদন্ত সংস্থা। শুক্রবার (২১ জুন) সমকালে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
জবানবন্দিতে কাদের জানান, সিরাজের সঙ্গে তার অনেক দিনের পরিচয়। সিরাজ ছিলেন তার শিক্ষক। সোনাগাজী মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি থেকে ফাজিল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কাদের। এরপর ওই মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কাদের বসবাস করতেন মাদ্রাসার পূর্ব দিকের ভবনের তৃতীয় তলায়। ৪-৫ বছর ধরে সিরাজের ব্যাপারে অনেক খারাপ কথা শুনে আসছেন তিনি। শুনেছেন তার চরিত্রও খারাপ। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অনেকবার অশোভন আচরণ করেছেন। অনেককে যৌন হয়রানি করেছেন। নুসরাতের ঘটনা ছাড়াও মাস তিনেক আগে আরেক ছাত্রীর সঙ্গে 'খারাপ' আচরণ করেন সিরাজ। পরে ওই ছাত্রীর বাবা মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু গভর্নিং বডির সহসভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন, কমিশনার মাকসুদ ও জামশেদ পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেন।
নুসরাতের সঙ্গে অশালীন আচরণের কথা জানিয়ে কাদের উল্লেখ করেন, ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ নুসরাতের গায়ে হাত দেন। এটা তিনি শুনেছেন, তবে দেখেননি। এ ঘটনায় নুসরাতের মা মামলা করলে গ্রেফতার হন সিরাজ। পরে সিরাজের সঙ্গে গিয়ে কারাগারে দেখা করেন কাদেরসহ অন্যরা। এসব ঘটনা নিয়ে সোনাগাজীতে পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল হয়। তবে মিছিলে যোগ দেননি কাদের। ১ এপ্রিল কারাগারে অধ্যক্ষর সঙ্গে দেখা করতে যায় শাহাদাত হোসেন শামীম, নূর উদ্দিন, সিরাজের দুই ছেলে মিশু, আদনাসহ কয়েকজন। তবে ওই দিন কারাগারে সিরাজের সঙ্গে দেখা করতে যাননি কাদের।
তবে সিরাজের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে কারাগারে সাক্ষাতের কথা বর্ণনা করে কাদের জানান, ৩ এপ্রিল তিনি সিরাজের সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিল শাহাদাত হোসেন শামীম, শামীম, নূর উদ্দিন, জোবায়ের, শরীফ, জাবেদ, এমরান, রানা, শাকিল ও সিরাজের দুই ছেলে মিশু, আদনান এবং তাদের আত্মীয় জনৈক মাহবুব। অধ্যক্ষ তাদের কাছে জামিনের কী খবর তা জানতে চান। সিরাজ বলছিলেন, তিনি নির্দোষ। কারাগার থেকে তাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কারাগারে যাওয়া সবার সঙ্গে কথা বলার পর নূর উদ্দিন, শামীম, শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ, জোবায়ের ও কাদেরের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন সিরাজ। তবে নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীমের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কথা বলেছিলেন। সিরাজ সবার উদ্দেশে বলেন, যৌন হয়রানির মামলা তোলার জন্য নুসরাতকে চাপ দিতে হবে। নুসরাত রাজি না হলে প্রয়োজনে তাকে মেরে ফেলতে হবে। এ সময় কাদেরসহ অন্যদের সঙ্গে আলাদাভাবে ৫-৬ মিনিট কথা বলেন সিরাজ।
মুক্তি পরিষদ গঠনের কথা জানিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষক কাদের জানান, ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার হোস্টেলে মিটিং করে সিরাজের মুক্তি পরিষদ গঠন করা হয়। মিটিংয়ে কাদের ছিলেন না। মুক্তি পরিষদের আহ্বায়ক করা হয় নূর উদ্দিন ও যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় শাহাদাত হোসেন শামীমকে। তারা দু'জন সিরাজের খাস লোক। মাদ্রাসার সব সুযোগ-সুবিধার ভাগ তারা পেত। তাই সব দায়িত্বও তারা নেয়। মুক্তি পরিষদ গঠনের বিষয় কাদেরকে জানায় শামীম। ৪ এপ্রিল রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে শামীম কাদেরকে ডেকে পশ্চিম দিকের ছাত্র হোস্টেলের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ, জোবায়ের, এমরান, রানা, শরীফ ও শাকিলকে দেখেন কাদের। ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় আগে মামলা ওঠানোর জন্য চাপ দেওয়া হবে। এতে নুসরাত রাজি হলে তার বক্তব্য রেকর্ড করে আদালতে দাখিলের মাধ্যমে সিরাজকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করা